ফিরে এসো নীলাঞ্জনা [৩]
তিন
জীবনে একটিও কবিতা লেখেনি, জাপানে না কি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশেও এমন কেউ নেই, যার জীবনে প্রেম আসেনি। প্রেম এক ধরনের মোহ। দুর্নিবার সেই মোহে পড়ে অনেকের জীবনই তছনছ হয়ে গেছে। প্রেমের কারণে আত্মহত্যার ঘটনাও কম নয়। ভালোবেসে বিয়ে করতে না পেরে এমনও অনেক পুরুষ ও নারী আছে, যারা সারাটা জীবন একা-একা কাটিয়ে দিয়েছে। আবার ভালোবাসার পাত্র বা পাত্রীকে বিয়ে করে অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অর্থাৎ পরকীয়া প্রেমের ঘটনাও কম নয়। প্রেমের কোনো জাত নেই। কোনো ধর্ম নেই, কূল নেই। সর্বোপরি প্রেমের কোনো বয়স নেই। প্রেম তো প্রেমই, কাউকে চিরদিন ভালো না লেগে অন্য কাউকে ভালো লাগতেও তো পারে, সেটা পরকীয়া হবে কেন! তবে সমাজ সেটাকে খাটো করে দেখে। সমাজ তো মানুষকে শৃংখলিত করার জন্যই। এক এক সমাজে এক এক নিয়ম কেন? নিয়মগুলো ক্লাসিক হলে তো সব সমাজে একই রকম হতো। তা তো নয়!
রবীন্দ্রনাথ ৬৩ বছর বয়সে ৩৪ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন নারী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রেমে পড়েছিলেন। ওকাম্পো তখন একজন সম্পূর্ণ নারী। রবীন্দ্রনাথ পার হয়েছেন প্রৌঢ়ত্বের সীমানা। ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিলন হয়নি হয়ত তিনি চাননি বলে। তবে তাঁর জীবন ও স্মৃতিতে স্থান দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়াকে। তার ‘বিজয়া’কে তিনি গানে-কবিতায় মূর্ত করে তুলেছিলেন বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে।
পাবলো পিকাসো ৬৪ বছর বয়সে ফ্রাঁসোয়া জিলো নামের ২১ বছর বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে দিব্যি সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। বিয়ে না করলেও দুটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন তারা। সন্তানদের স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন পিকাসো। তিনি ৭০ বছর বয়সে আবার প্রেমে পড়েছিলেন জেনেভিয়েভ লাপোর্ত নামে ২৪ বছর বয়সী আরেক ফরাসি যুবতীর।
প্রেমে পড়ার জন্য বয়স কোনো ব্যাপার নয়Ñএমনই মনে করতেন আজকের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘মেমোরিজ অব মাই মেলানকলি হোরস’-এর (আমার স্মৃতির বিষাদ গণিকারা) নায়ক নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত জীবন কাটিয়ে হঠাৎ একটি কুমারী মেয়ের ভালোবাসা পেতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন এবং সেই ভালোবাসার সন্ধান পেয়ে অতীতের প্রেমহীন জীবনের অসারতাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
রজকিনির প্রেমে মশগুল হয়েছিল চন্ডিদাশ, জুলেখার প্রেমে ইউসুফ। লাইলী-মজনু ও রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনীও আমরা জানি। অবতার শ্রীকৃষ্ণ ও আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধার প্রেমকাহিনী কে না জানে! কী অদ্ভুত রাধা-কৃষ্ণের ভালোবাসাকে কিন্তু সমাজ পরকীয়া বলেনি! মানুষে-মানুষে, জীবে-জন্তুকে প্রেম না থাকলে সৃষ্টিজগত টিকে থাকত না। তবুও প্রেম মরীচিকা। মরীচিকার পিছনে ছুটতে-ছুটতে কত প্রেমিক যে পথ হারিয়েছে, তার খবর ইতিহাস লিখে রাখে না। ইতিহাস বড্ড একচোখা!
অমিতের জীবনেও প্রেম এসেছিল, তবে তা খুবই নিঃশব্দে। অমিত যখন তেরে-চৌদ্দ বছরের কিশোর, তখন তার চেয়ে দুবছরের ছোটো একটি বালিকাকে ভালোবেসেছিল সে। অমিতের সে প্রেমের অঙ্কুরোগমন হয়নি। পত্রপল্লবে বিকশিত হয়নি তার ভালোবাসা। তার আরাধ্য বালিকাকে সে কখনো জানাতে পারেনি তার অন্তরের আকুলতার কথা। তার জীবনে আসা একটিমাত্র অস্পষ্ট ধূসর প্রেমকে অমিত সত্য বলে মেনে নিয়েছে। তার মানসসরোবরে একটি বালিকা পদ্ম হয়ে ফুটে আছে সারা জীবন। এ জীবনে তার অন্য কোনো নারীর প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। প্রেমের ক্ষেত্রে অমিত ঋষী, ধ্যানী। মাত্র দশ-এগারো বছরের একটি বালিকাকে ভালোবেসে বাকি জীবনকে সে কাটিয়ে দিতে পারে। রবীন্দ্রনাথের গানটি তার খুব প্রিয়। প্রায়ই অমিত গুন গুন করে গায়Ñ
‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে।
তাই স্বপ্ন মনে হলো তারেÑ
দিইনি তাহারে আসন।
বিদায় নিলো যবে, শব্দ পেয়ে গেনু ধেয়ে।
সে তখন স্বপ্ন কায়াবিহীন
নিশীথতিমিরে বিলীনÑ
দূরপথে দীপশিখা রক্তিম মরীচিকা ॥’
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একাধিক মেয়ে অমিতকে ভালোবেসেছিল। তার মধ্যে ঝিনুক অন্যতম। বার-বার প্রোপোজ করার পরও অমিতের সাড়া না পেয়ে ঝিনুক মনে করেছিল অমিত মন নয়, দেহ চায়। যেভাবেই হোক অমিতকে খুশি করতে চেয়েছিল ঝিনুক। একদিন ঝিনুক অমিতকে প্রশ্ন করেছিল ‘কী চাও তুমি?’ অমিত খুব স্পষ্টভাবে বলেছিল, তোমার কাছে কিছুই চাওয়ার নেই আমার।’
ঝিনুক উত্তরে বলেছিল, ‘যিনি আমার বাবা সে কয়েকটি কোম্পানির মালিক। বাবার সব সম্পত্তি তো আমারই। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে তোমার সারাজীবনেও কোনো ভাবনা থাকবে না। গাড়ি-বাড়ির মালিক তো তুমিই হবে। বাবার বিশাল ব্যবসা তোমাকেই দেখতে হবে।’
অমিত অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল ঝিনুকের দিকে আর মনে মনে ভাবছিল তাহলে টাকা-পয়সা, বিষয়-বৈভব দিয়ে হলেও ঝিনুক তাকে কিনতে চাচ্ছে! প্রেমের বাজারেও কেনাবেচা চলে!
‘কিছু বলছ না যে!’ ঝিনুক বলেছিল।
‘আমি খুব সাধারণ। নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। আমার পরিবারে সবার জন্য দুমুঠো ভাত যোগার করতে আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। তারপরও কোনো দান বা হঠাৎ আলাদিনের চেরাগ পেতে চাই না আমি। তুমি অন্যকিছু ভাবো। সরি ঝিনুক।’
‘এটা তোমার মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্ট।’
‘এটাই আমার অহংকার।’
ঝিনুক অমিতের কথা শুনে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, একদিন সে অমিতের সকল অহংকার তছনছ করে দেবে!
‘শুক্রবার ক্লাস নেই। আমার বাসায় যাবে?’
‘কেন?’
‘গল্প করব।’
‘এখানে করো। বাসায় যেতে হবে কেন?’
‘সব গল্প সব জায়গায় করা যায় না। বাসায় কেউ থাকবে না। বাবা-মা সিঙ্গাপুর গেছে সাতদিনের জন্য। এই সাতদিন তুমি আমার বাসায় থাকবে। তুমি যা চাও, পুরুষরা যা চায় সব তোমাকে দেবো। আমি আমাকে উজার করে দিতে চাই তোমাকে, তবু তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না।’
অমিতের চোখে সেদিন ঘৃণার আগুন ঠিকরে পড়ছিল। এসব কিছুতে নিরাসক্ত অমিত লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে টিএসসির দিকে হেঁটে গিয়েছিল। পিছন থেকে ঝিনুক তাকে বার-বার ডাকছিল। অমিত একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি।