অনন্য প্রতিভা নজরুল

 

কাজীদার গল্প [২]

বাংলা সাহিত্যের অমর গীতিকার, সুরকার ও বিদ্রোহী কবি নজরুল এক ক্ষণজন্মা বিস্ময়কর প্রতিভা। নজরুল রচিত গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। মতান্তরের সাড়ে চার হাজার। অধিকাংশ গানে কবি নিজেই সুরারোপ করেছিলেন। গজল, রাগপ্রধান, কাব্যগীতি, উদ্দীপক গান, শ্যামাসংগীত, ইসলামিসহ বহু বিচিত্র ধরনের গান তিনি রচনা করেছেন তিনি।

নজরুল হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে গানটি গাইতে থাকতেন আর গ্রামোফোন কোম্পানির স্ক্রিপ্ট লেখকেরা সেটা দ্রুতগতিতে লিখে নিতেন অথবা কবি নিজেই গাইতেন ও লিখতেন। এভাবে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটি রাগের কাঠামোর প্রতিটি অঙ্গের আকার অনুযায়ী সুন্দর সুন্দর পঙক্তিগুলো রূপায়িত হয়ে উঠত একটি সম্পূর্ণ গানের শরীরে।

নজরুলের সমালোচকরা কখনোই নজরুলের গানের সমালোচনা করতে সাহস করেন না। বাংলা গজলের প্রচলন তিনিই করেছিলেন। বাঁধনহারা নজরুল যা কিছু করতেন হুটহুট করেই করে ফেলতেন। গান রচনার ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেছে। হারমোনিয়ামে আঙুল চালাতে চালাতে গুন গুন করে লিখে ফেলতেন এক একটি গান। তিনি গাইতে গাইতে বা শেখাতে শেখাতেই তার নিজের লেখা গানগুলোর পূর্ণতা দিতেন কথা ও সুরে। 

কাজী দা পুরান ঢাকায় বনগ্রামের বাড়িতে গান শিখিয়েছেন প্রতিভা সোম বা রানু সোমকে, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করার পরে যিনি হন প্রতিভা বসু। নজরুলের বন্ধু বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের সূত্রে প্রতিভার পরিবারের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়। দিলীপ ছিলেন সাহিত্যিক ও সুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র। প্রতিভাকে গান শেখাতেন দিলীপ কুমার। আর সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছিলেন বন্ধু নজরুলেরই গান।

নজরুল এক সন্ধ্যায় তার নিজের ফিটন গাড়িতে চড়ে হাজির হন রানু সোমের বাড়িতে। অনেক রাত পর্যন্ত গান শেখান। পরদিন সকালে আবার হাজির হন তাদের বাড়িতে। 

নজরুলকে দেখে রানু অবাক হয়েছিলেন, কারণ এতটা তিনি আশা করেননি। ‘জীবনের জলছবি’ বইয়ে প্রতিভা বসু লিখেছেন, রাত জেগে নতুন গান লিখেছেন নজরুল। গানটা হলো, ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, এ কোন সোনার গায়/ ভাটির টানে আবার কেন উজান যেতে চায়।’ রানু বলছেন, ‘দেখা গেল তখনো তার বয়ান সঠিক নয়, সুরেরও হেরফের হচ্ছে। ঠিক করছেন গাইতে গাইতে, শেখাতে শেখাতে।’


বুদ্ধদেব বসুর বর্ণনা

নজরুলের গান রচনার সময়কালের বর্ণনা অনেকেই দিয়েছেন। তবে বুদ্ধদেব বসুর বর্ণনা বেশি প্রাঞ্জল মনে হয়। ঢাকায় এসে নজরুল বুদ্ধদেবের পল্টনের টিনের বাড়িতে বহুদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত ‘প্রগতি’ পত্রিকায় লেখা দিয়েছেন। বুদ্ধদেবও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে নজরুলের আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠান করেছেন। সেবার (১৯২৮) নজরুল ঢাকায় এসে উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেনের বাড়িতে। আবুল হুসেন তখন মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও এর মুখপত্র শিখা গোষ্ঠীর নেতা।

বুদ্ধদেব ও তার বন্ধুরা নজরুলের খোঁজে ওই বাড়িতে যেতেন। ওই বাড়িতে নজরুলকে গান রচনা করতে দেখেছেন বুদ্ধদেব। ‘আমার যৌবন’ বইয়ে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘সৃষ্টিকর্মটি যে নির্জনতা দাবি করে বলে আমরা চিরকাল শুনে এসেছি, তার তোয়াক্কা রাখতেন না নজরুল, ঘরভর্তি লোকের উপস্থিতি তাকে বিব্রত করতো না মুহূর্তের জন্য, বরং অন্যদের চোখে চোখে তাকিয়ে হাসির উত্তরে হাসি ফুটিয়ে, তিনি যেন নতুন প্রেরণা সংগ্রহ করতেন।

সামনে হারমোনিয়াম, পাশে পানের বাটা, হারমোনিয়ামের ঢাকার ওপরে খোলা থাকত তার খাতা আর ফাউন্টেনপেনÑতিনি বাজাতে বাজাতে গেয়ে উঠতেন একটি লাইন, তার বড়ো বড়ো সুগোল অক্ষরে লিখে রাখতেন খাতায়, আবার কিছুক্ষণ বাজনা, তারপরÑদ্বিতীয় লাইন-তৃতীয়-চতুর্থ লাইনÑএভাবেই পুরো গান লেখা হয়ে যেত! এমনি করে, হয়তো আধ ঘণ্টার মধ্যে, “নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরান পিয়া” গানটি রচনা করতে আমি তাকে দেখেছিলামÑদৃশ্যটি আমার দেবভোগ্য বলেই মনে হয়েছিল।’

বুদ্ধদেব বসুর মতে, সুরের নেশায় গানের কথা খুঁজে পেতেন নজরুল আর কথার ঠেলা সুরকে এগিয়ে নিত।

চলচ্চিত্রে কবি কাজী নজরুলের

নজরুলের কালে নামকরা প্রযোজক পিরোজ ম্যাডান ১৯৩৩ সালে পাইওনিয়ার ফিল্মস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। পুরাণের কাহিনি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ধ্রুবচরিত’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। নজরুল এ ছবির গান লেখেন এবং সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি দেবর্ষী নারদের চরিত্রে অভিনয় এবং একটি গানে কণ্ঠ দেন।

১৯৩৪ সালের পহেলা জানুয়ারি ‘ধ্রুব’ মুক্তি পায়। ওই চলচ্চিত্রে নিজেকে একেবারে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছিলেন নজরুল। যেমন স্বর্গের সংবাদবাহক এবং দেবর্ষী নারদের চরিত্রে সব সময় দেখা যায় জটাধারী, দীর্ঘ শ্মশ্রুম-িত বৃদ্ধ একজনের চেহারা। কিন্তু নারদ নজরুল ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। তার নারদ এক সুদর্শন যুবক। হাসি-হাসি মুখ। চুড়ো করে মালা বাঁধা ঝাঁকড়া চুল, ক্লিন শেভড। পরনে সিল্কের লম্বা কুর্তা, গলায় মালা। চলচ্চিত্রের পর্দায় এভাবেই নারদরূপে আবির্ভূত হলেন নজরুল। নারদ চরিত্রে নজরুলের সাজসজ্জা নিয়ে সে সময় পত্রিকায় সমালোচনা হয়েছিল যথেষ্ট। পাত্তা দেননি নজরুল। নজরুল তার জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমি চিরতরুণ ও চিরসুন্দর নারদের রূপই দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’ ম্যাডান থিয়েটার্স বিভিন্নভাবে নজরুলের প্রাপ্য সম্মানি নিয়ে প্রতারণা করায় ১৯৩৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন তিনি।

পরিচালক নজরুল

নজরুল নিজে পরিচালনা করেছেন ‘ধূপছায়া’ নামের একটি চলচ্চিত্র। সিনেমাটিতে দেবতা বিষ্ণুর চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। ১৯৩১ সালে অমর চৌধুরী পরিচালিত সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাইষষ্ঠী’তে সুরকারের ভূমিকায় কাজ করেন নজরুল। ১৯৩১ সালের ১১ই এপ্রিল জেএফ ম্যাডান কোম্পানির সবাক চিত্র ‘জামাইষষ্ঠী’ ক্রাউন সিনেমা হলে মুক্তি পায়। ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন অমর চৌধুরী। একই বছর বাংলা সবাক চিত্র ‘জলসা’য় নজরুল নিজের একটি গান গেয়েছিলেন এবং ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন।


কাহিনিকার ও সুরকার

১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘সাপুড়ে’। এর কাহিনিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। পরিচালক দেবকী বসু। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনভিত্তিক এ সিনেমা দারুণ ব্যবসা সফল হয়েছিল। বেদে জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরুল বেশ কিছুদিন বেদে দলের সঙ্গে ছিলেন। ‘সাপুড়া’ নামে সিনেমাটির হিন্দি রিমেকও হয়েছিল। তার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন নজরুল।

১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। তিনি এবং পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এ ছবির গীতিকার। ‘পাতালপুরী’ সিনেমাটি কয়লাখনির শ্রমিক ও সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এ ছবির জন্য ‘ঝুমুর’ সুরে গান রচনা করেন নজরুল। তিনি কয়লাখনি অঞ্চল সম্পর্কে জানার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গৃহদাহ’ সিনেমার সুরকার ছিলেন নজরুল। এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পায় রহস্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গ্রহের ফের’। এ ছবির সংগীত পরিচালক ও সুরকার ছিলেন নজরুল।

১৯৩৭ সালের আলোচিত চলচ্চিত্র ‘বিদ্যাপতি’। কবি বিদ্যাপতির জীবনীভিত্তিক এ ছবির মূল গল্প ছিল নজরুলের। যদিও চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় ছিলেন দেবকী বসু। ছবিটির সুরকার ছিলেন নজরুল ও রাইচাঁদ বড়াল। মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির বিভিন্ন কবিতায় নজরুলের সুরারোপের কাজ ছিল অসাধারণ। বাংলা ‘বিদ্যাপতি’র সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দিতে নির্মিত হয় ‘বিদ্যাপতি’। সে ছবিও ব্যবসাসফল হয়েছিল।


বিশ্বভারতীকে পাত্তা দিতেন না নজরুল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘গোরা’। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। বিশ্বভারতী আপত্তি করে যে ছবিটিতে সঠিকভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হচ্ছে না। কাজী নজরুল তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি চলে যান কবিগুরুর কাছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকেই সমর্থন করে বিশ্বভারতীর সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আমার গান কীভাবে গাইতে হবে, সেটা কি তোমার চেয়ে ওরা ভালো বুঝবে?’ তিনি নজরুলকে তার গান নিজের খুশিমতো গাওয়ার ও ব্যবহারের অনুমতিপত্র দিয়েছিলেন। নজরুল সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি নিজের লেখা একটি গান এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ব্যবহার করেছিলেন। সে সময় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হালবাংলা’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্রের গানেও সুর করেছিলেন নজরুল। চলচ্চিত্রে কৌতুকময় একটি ছোটো চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি।


নজরুলের হিন্দি গান রচনা

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে হিন্দি গানও রচনা করেছেন, সে খবর আজকাল কজনেই বা রাখেন। তবে এটা ধ্রুব সত্যি যে, কাজীদা সাতটি হিন্দি গান রচনা করেছিলেন। ১৯৪২ সালে নির্মিত ‘চৌরঙ্গী’ চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। পরে ‘চৌরঙ্গী’ হিন্দিতে নির্মিত হলে সে ছবির জন্য সাতটি হিন্দি গান লেখেন নজরুল। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিলরুবা’ চলচ্চিত্রের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল।


কবি অসুস্থ তাই মদিনা মুক্তি পায়নি!

১৯৪১-৪২ সালে ‘মদিনা’ নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল। এ সিনেমার জন্য তিনি ১৫টি গান লেখেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়ায় সিনেমাটি আর মুক্তি পায়নি।


‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ কাজীদার চলচ্চিত্র ব্যবসা

চলচ্চিত্র ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছিলেন নজরুল। ১৯৪১ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, এস ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম, সারওয়ার হোসেন, আজিজুল হক প্রমুখ।


চলবে


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url