অপারেশন রেসকিউ [১]
প্রথম পর্ব ।।
আজকের দিনটা খুব সুন্দর। চারদিকে চকচকে রোদ। ঝিরিঝিরি বাতাস। ধানের নবীন চারাগুলো দুলছে আপন মনে। কিন্তু আমার মন ভালো নেই—একেবারেই না। কী করে মন ভালো থাকে? বাবা আজ সকালে সবগুলো ঘুড়ি ও লাটাই ভেঙে তছনছ করে দিয়ে বলেছেন, আমাকে আর কোনোদিন ঘুড়ি ওড়াতে দেবেন না! অথচ ঘুড়ি না ওড়ালে আমার দিন কাটবে কেমন করে! আমি তো আর ফুটবল, হা-ডুডু খেলতে যাই না। সাঁতার কাটতেও নদীতে ঝাঁপ দেই না। স্কুল আর লেখাপড়া ছাড়া আমার তো আর সময় কাটাবার কোনো পথই রইলো না!
মা বললেন, ঘুড়ি না ওড়াস তাতে কী? বই পড়বি।
বললাম, পড়িই তো! বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস, ভূগোল, দস্যু বনহুর, বাহরাম বাদশা আরও কতো কী বই পড়ি আমি!
মা বললেন, তার তো এই নমুনা! পর পর দু-বছর একই ক্লাসে রয়ে গেলি! আচ্ছা অনিন্দ্য, লোকের কাছে মুখ দেখাই কী করে বল তো?
অতোশতো ভেবো না তো মা। আগামী বছর ঠিকই পাস করে নেবো।
মা আমার কথায় খুশি হতে পারলেন বলে মনে হলো না।
বাবাকেই-বা দোষ দেই কী করে। এই নিয়ে দু-দুবার ক্লাস এইটে ফেল করলাম আমি। আর তরুণ, মোস্তাক, নূরু, শান্ত ওরা তর-তর করে উপরের ক্লাসে উঠে গেলো। আর আমি? নিজের উপর খুব রাগ হলো আমার। বাবা না, মাও না, নিজের উপর রাগ করেই ঘর থেকে বের হলাম আমি।
সকাল থেকে সন্ধ্যা এখানে-ওখানে ঘুরলাম। মন খারাপ করে নদীর ঘাটে বসে রইলাম। টিপ-টিপ বৃষ্টির কারণেই আজ হয়তো খেয়াঘাটে লোকজন খুব একটা নেই। তবুও পরিতোষ খেয়ানৌকা নিয়ে বসে আছে। পরিতোষ অবিনাশের ছোটো ভাই। বয়সে অবিনাশের চেয়ে তিন বছরের ছোটো। অবিনাশ আমার বন্ধু। প্রাইমারি স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম আমরা।
খুুব ভালো ছাত্র ছিলো অবিনাশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর লেখাপড়া হলো না ওর। যেদিন ক্লাস ফাইভে অবিনাশ দ্বিতীয় স্থান নিয়ে পাস করলো, সেদিনই ব্রেইন স্টোক করে এক হাত প্যারালাইজড হয়ে অচল হয়ে পড়লেন ওর বাবা। বাবার শারীরিক অক্ষমতার কারণে সংসারের দায়িত্ব পড়লো অবিনাশ ও পরিতোষ দুই ভাইয়ের ওপর। সেই থেকে বাবার বদলে খেয়াঘাটে লোকজনকে পারাপারের দায়িত্ব নিয়েছে ওরা দু-ভাই।
বাবা, মা ও ছোটো এক বোনকে নিয়ে অবিনাশ ও পরিতোষদের ছোট্ট সংসার। সংসারের বোঝা মাথায় নেয়ায় অবিনাশ ও পরিতোষের কারোরই আর লেখাপড়া করা হলো না। পরিতোষ বাবার পেশা খেয়ানৌকার মাঝি হয়েছে, আর অবিনাশ বাজারে ছোট্ট একটি দোকান দিয়ে আয়-রোজগারের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
পরিতোষকে বললাম, বৃষ্টির মধ্যে বসে আছো কেন? লোকজনও তো নেই।
পরিতোষ একগাল হেসে বললো, বৃষ্টি বলে কি লোকজন খেয়া পার হবে না দাদা?
কিন্তু লোকজন নেই তো?
যদি আসে?
বুঝলাম পরিতোষ খুব দায়িত্বশীল।
দাদা, তুমি তো অনেকদিন আমাদের বাড়িতে আসো না। মা কতো বলেন তোমার কথা। আজ যাবে আমাদের বাড়িতে?
পরিতোষের কথা শুনে মনটা যেনো কেমন করে উঠলো। ওর মা মানু মাসি খুব ¯েœহ করেন আমাকে। গেলেই চিড়া-মুড়ি, সন্দেহ আরও কতো কি খেতে দেন! আহা, কতোদিন দেখা হয় না মানু মাসীর সঙ্গে! খুব দেখতে ইচ্ছে হলো তাকে। বললাম, হ্যাঁ যাবো।
Ñসত্যি বলছো দাদা? যাবে আমাদের বাড়িতে?
Ñযাবো। নৌকা ভিড়াও পরিতোষ।
ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে পরিতোষ খুব খুশি হলো।
নৌকায় উঠে পরিতোষের সঙ্গে গল্প করতে-করতে ওপার গিয়ে পৌঁছলাম। নৌকা ঘাটে বেঁধে রেখে পরিতোষ আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে ছুটলো। আমাকে পেয়ে ওর যে কি আনন্দ, তা বোঝানো যাবে না। যেতে যেতে বললো, তুমি কেমন মানুষ অনিন্দ্য দা!
কেনো, কী হয়েছে?
কেনো আবার। তুমি তো আমাদের কথা মনেই রাখো না!
কে বললো, তোমাদের কথা মনে রাখি না?
যদি মনেই রাখতে তাহলে এতোদিনে একবারের জন্যে হলেও আমাদের বাড়িতে আসতে।
বললাম, ঠিক আছে, আর ভুল হবে না।
অবিনাশদের বাড়িতে গিয়ে জানলাম, কয়েকদিন ধরে জ্বর ওর। তাই আজ আর দোকানে যায়নি। আমাকে পেয়ে মানু মাসী ও অবিনাশ খুব খুশি হলো।
এ-কথা ও-কথার পর অবিনাশকে বললাম, আমি আর পড়তে চাই না অবিনাশ।
অবিনাশ অবাক হয়ে বললো, কেনো?
কেন আবার? বার-বার ফেল করলে কি আর পড়তে ভালো লাগে কারো?
তা লাগে না। কিন্তু ফেল করবি কেন?
কেন করি, তাও তো বুঝি না।
অবিনাশ আমার কথা শুনে হাসলো। তারপর হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে বললো—দেখ অনিন্দ্য, ভগবান কিন্তু সবাইকে সবরকম সুযোগ দেন না। তোর সামর্থ আছে লেখাপড়া করার। অথচ আমার সে ভাগ্য নেই। বাবা অচল হয়ে গেলেন। সংসারের বোঝা চাপলো ঘাড়ে।
অবিনাশের কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। বললাম, ত্ইু আবার স্কুলে ভর্তি হ। আমরা বন্ধুরা না হয় তোর লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করে দেবো।
আমার কথায় অবিনাশ খুশি হলো কিনা বোঝা গেলো না। বললো, এতোটা স্বার্থপর হলে কি চলে? তুই তো জানিস, বাবা অচল, পরিতোষ ও আমার আয়ে সংসার চলে। আমরা লেখাপড়া করতে গেলে তো না খেয়েই মরতে হবে!
অবিনাশের কথায় খুব কষ্ট হলো আমার। ও যখন এসব বলছিলো, তখন নিজের সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম আমি। ভেবে দেখলাম ওর কষ্টের কাছে আমার কষ্ট অতি তুচ্ছ। অতি সামান্য।
অবিনাশ আবারও বললো, তোরা লেখাপড়া কর। তোরা যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অধ্যাপক হতে পারিস তাহলে তো অহংকার আমারই। তোরা যে আমার বন্ধু! সেদিন তোরা যখন এই গরীব বন্ধুটির কথা মনে করে একবারের জন্যে হলেও নাম ধরে ডাকিসÑ‘এই অবিনাশ’ সেই তো আমার পরম প্রাপ্তি। এর চেয়ে বেশি কিছু কী আর চাই বল?
ওর কথায় কোন উত্তর দিতে পারলাম না। মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
অবিনাশ আবারও বললো, তোর কী হয়েছে অনিন্দ্য? বাড়িতে মাসিমা বুঝি খুব বকেছে আজ?
বললাম, বকবে না! বকারই তো কথা।
Ñতোর মুখ এতো শুকনো লাগছে কেন? সারাদিন কিছু খাসনি বুঝি?
না।
মাকে ডাকছি। তোকে খাবার দেবে।
অবিনাশকে নিষেধ করলাম। ও আমার কথা শুনলো না। মাকে ডেকে আনলো।
অবিনাশের মা মানু মাসী আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, কীরে অনিন্দ্য, একেবারে ভুলে গেলি মানু মাসীকে?
মানু মাসীর কথা শুনে খুব লজ্জা পেলাম। বললাম, না-না মাসীমা, ভুলবো কেন?
তাহলে আসিস না কেন?
এরপর আসবো।
আসবি না। তবুও বলছিস আসবো? এর আগেও তো বলেছিলি মাকে নিয়ে আসবি। কই এসেছিস একদিনও?
Ñমাকে বলেছিলাম তোমার কথা।
Ñতাহলে? মা আসতে চাননি? ঠিক আছে আমি যাবো তোর মাকে দেখতে।
কোথা থেকে অবিনাশের ছোটবোন মাধবী দৌড়ে এসে বললো, অনিন্দ্য দা যে!
বললাম, তুমি তো মাধবী?
মাধবী খুব অবাক হলো। বললো, কেন চিনতে পারছো না বুঝি?
কী করে চিনবো বল! এই তিন বছরে কতোটা বড় হয়ে গেছিস তুই! মানু মাসীকে বললাম, মাসীমা মাধবী তো খুব বড় হয়ে গেছে। এবার ওর একটা বিয়ে দিয়ে দাও।
আমার কথা শুনে মানু মাসী মুখ টিপে হাসলেন।
মাধবী হঠাৎ আমার পিঠে কয়েক ঘা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো, ভালো হচ্ছে না কিন্তু অনিন্দ্য দা।
বললাম, কী?
মাধবী বললো, এই যে বললে বিয়ের কথা।
কেন, বিয়ে করবে না তুমি?
না।
সত্যি?
সত্যি।
মাধবী হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো, কী হয়েছে তোমার অনিন্দ্য দা? তোমার মুখ এতো শুকনো কেন? তুমি কি অসুস্থ?
অবিনাশ বললো, সারাদিনে ও কিছুই খায়নি।
মানু মাসী বললেন, কেন?
অবিনাশ বললো, রাগ করে বাড়ি থেকে সেই সকালবেলা বের হয়েছে, খাবে কী করে?
মানু মাসী বললেন, কার সঙ্গে রাগ, কেন?
অবিনাশ মাকে আড়ালে ডেকে কী যেন বললো। মা ভিতরে চলে গেলেন।
মাধবী বললো, তোমার এতো রাগ কেন অনিন্দ্য দা?
বললাম, রাগ! কই?
কেন মনে নেই, রাগ করে একবার তুমি আমার হাত মুচড়ে দিয়েছিলে। আর একবার আমার প্রিয় পুতুলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে?
বললাম, তুই বুঝি সে কথা আজও মনে রেখেছিস?
আমার কথা শুনে মাধবী খুব মন খারাপ করলো। বললো, রাখবো না? চিরদিন মনে রাখবো।
বললাম, তাহলে তোদের বাড়িতে আর কোনদিন আসবো না।
আমার সামনে এসে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো মাধবী। বললো, ও তো এমনি বলেছি অনিন্দ্য দা। তুমি রাগ করো না প্লিজ।
তাহলে বল তুই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস।
মাধবী জিভ কেটে বললো, ছিঃ ছিঃ অনিন্দ্য দা, ওভাবে বলো না। তোমার ওপর যদি রাগ করে থাকতাম তাহলে তোমার দেয়া পুতুলটা কি আজও যতœ করে রেখে দেই?
কোন পুতুলটা?
মনে নেই তোমার?
না তো!
তুমি যে কী! কিছুই মনে থাকে না তোমার?
Ñনা, মনে থাকে না।
বসো তাহলে, এই একটু আসছি।
মাধবী দৌড়ে ঘরের ভিতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ছোট্ট একটি পুতুল নিয়ে এসে আমার সামনে ধরে বললো, এই দেখো, মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলে তুমি।
কবে?
যে বছর তোমরা ক্লাস ফাইভে পাস করলে, সে বছরই তো।
এইবার মনে পড়েছে। এখন পড়িস না তুই?
পড়ি তো।
হাইস্কুলে?
হুঁ।
এ জন্যেই বলছিলাম তোকে এবার বিয়ে দেয়া উচিত।
মাধবী আবারও আমার পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে ছুটে পালালো।
মানু মাসী কাঁসার প্লেটে করে সন্দেশ, নাড়–, চিড়া-মুড়ি আরও কতো কি নিয়ে এলেন। তারপর নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে অনিন্দ্য, আমি তোর মাসী মা, না কি? জানিস তো মাসীর গা থেকে মায়ের গন্ধ পাওয়া যায়।
আমি মাথা নাড়লাম। দীর্ঘ তিন বছরে মানু মাসীকে একবারও দেখতে আসিনি বলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে এলো আমার। ততোক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
অবিনাশ বললো, চল এবার তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মাসীমাকে প্রণাম করলে তিনি আমার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বললেন—ভুলে যাস না বাপ, পরিতোষ, অবিনাশ, তুই এবং মাধবীকে আমি ভিন্ন চোখে দেখি না। সে কথা তুই জানিস না বলেই তো মানু মাসীকে ভুলে থাকিস। তুই না এলে তোকে না দেখে থাকি কী করে বল তো?
মাসীমার কথার উত্তর দেওয়ার কোন ক্ষমতা নেই আমার। তার কথা শুনে আমার দুচোখের পাতা ভিজে এলো। আর একটু হলেই কেঁদে ফেলতাম আমি। মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, মানু মাসীকে মাঝে-মধ্যে এসে দেখে যাবো।
আস্তে-আস্তে নদীর ঘাটের দিকে রওয়ানা হলাম। যাবার সময় মাধবীকে খুঁজতে লাগলাম মনে-মনে। ওকে দেখতে না পেয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো আমার।
চলবে