রিন্টুর ভূতুড়ে কালো বিড়াল


নাসির আহমেদ কাবুল


ন্টু বলল, একটি বিড়াল ছানা তার চাই-ই চাই। এমন একটি বিড়াল তার দরকার, যা অন্য কারো নেই। সবার থেকে আলাদা হতে হবে তার বিড়াল ছানাটি। রিন্টুর মা জানেন রিন্টু একবার যা বলে, তার নড়চড় করার সুযোগ নেই। মা খুব ভাবনায় পড়ে গেলেনÑকী করে তিনি রিন্টুর জন্য সবার থেকে আলাদা একটি বিড়াল ছানা জোগাড় করবেন। ভেবে-ভেবে অস্থির হলেন তিনি, কিন্তু কিছুতেই তার সমাধান খুঁজে পেলেন না।

রিন্টু সবে পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে এবার। প্রতিদিন স্কুল শেষে বাসায় এসে হোমওয়ার্ক করতে-করতে সন্ধ্যা হয়ে যায় রিন্টুর। তারপর ক্লাসের পড়া শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে মায়ের কাছে বায়না ধরে গল্প শোনার জন্য। মা তাকে রূপকথার গল্প বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প বলেন। এতদিন রিন্টু এসব গল্প খুব পছন্দ করলেও সম্প্রতি তার ঝোঁক কালো বিড়ালের গল্পের দিকে। রিন্টুর মা বইমেলা থেকে নাসির আহমেদ কাবুলের লেখা ‘কালো বিড়াল লাল চোখ’ প্রথম খ- বইটি কিনে এনে গল্পগুলো পড়ে শুনিয়েছেন রিন্টুকে। এরপর থেকেই রিন্টুর বিড়ালের দিকে ঝোঁক বেড়ে যায়। ওর ক্লাসের বেশ কয়েকজনের বিড়াল আছে। এ জন্য রিন্টুর এমন একটি বিড়াল ছানা চাই, যেটা অন্য কারো সঙ্গে মিলবে না। সবার থেকে আলাদা হতে হবে তার নিজের বিড়ালটি।

মা অন্যরকম বিড়াল ছানা খুঁজলেন। তিনি দেখলেন সব বিড়াল ছানা তো একই রকম! কোনোটা ধূসর, কোনোটা সাদা, আবার কোনোটা সাদা-কালোয় মিশানো গায়ের রং। সব বিড়ালেরই গোঁফ আছে, সব বিড়ালই মিঁউ-মিঁউ করে ডাকে। সবার থেকে আলাদা একটি বিড়াল ছানা খুঁজে বের করতে তিনি দিশেহারা হয়ে একদিন রিন্টুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেনÑ‘হ্যারে রিন্টু, তোর বিড়াল ছানাটি কেমন হবে রে?’

রিন্টু বলল, সবার থেকে আলদা।

মা বললেন, কেমন হবে গায়ের রং?

রিন্টু বলল, সবার থেকে আলাদা।

মা আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ওর চোখ কেমন হবে?

রিন্টু এবারও বলল, সবার থেকে আলাদা।

মায়ের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, সে তো বুঝলাম তোর বিড়াল ছানাটি সবার থেকে আলাদা হবে, কিন্তু কেমন আলাদা হবে, সেটা বলবি তো?

রিন্টু ভাবনায় পড়ে গেল। মনে মনে ভাবল, সত্যিই তো সবার থেকে আলাদা বিড়াল ছানাটি কেমন হবে, না বললে মা বুঝবেন কী করে কেমন বিড়াল তার চাই।

রিন্টু মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা তুমি অহেতুক ভাবনায় পড়ে গেলে তো!

মা বললেন, অহেতুক নয় পাগলা। সব বিড়ালই যখন দেখতে একই রকম, তখন তোর জন্য আলাদা বিড়াল ছানা আমি কোথায় পাই সেটা বলবি তো?

রিন্টু বলল, সে ভাবনা তোমার মা। আমি বলছি সবার থেকে আলাদা একটি বিড়াল ছানা আমার চাই-ই চাই। তবে তোমাকে একটি ক্লু দিতে পারি।

ক্লু দেওয়ার কথা শুনে মা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, তোর ক্লুটা কী?

রিন্টু বলল, আমার বিড়ালের গায়ের রং হবে কালো কুচকুচে।

আর? মা জিজ্ঞেস করলেন।

রিন্টু বলল, ওর চোখ দুটি হবে লাল টকটকে।

মা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, বলিস কি! তুই কি ‘কালো বিড়াল লাল চোখ’ গল্পের কালো বিড়ালের কথা বলছিস?

রিন্টু বিজয়ের হাসি হাসতে-হাসতে বলল, ঠিক ধরেছ মা, আমার কালো বিড়াল লাল চোখের গল্পের বইটির মতো কালো রংয়ের বিড়াল চাই।

কিন্তু... 

কোনো কিন্তু নয় মা। ওরকমই চাই আমি।

মা বেঁকে বসলেন, বললেনÑনা রিন্টু, কালো বিড়াল ভয়ানক হয়। তুই তো গল্পে পড়েছিস, ওরকম বিড়ালের মধ্যে ভূত থাকে।

রিন্টু কোনো কথাই শুনতে চাইছে না দেখে মা ওর জন্য কালো বিড়ালের বাচ্চা খুঁজতে শুরু করলেন। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে রিন্টু নিজেই একটি বিড়াল ছানা হাতে নিয়ে হাজির হলো। বিড়াল ছানাটি ভীষণ রকম কালো, আর চোখ দুটি লাল টকটকে। তবে দেখতে বেশ সুন্দর।

মা আপাতত আশ্বস্ত হলেও তার মনের মধ্যে অজানা একটি ভয় সব সময় জেগে থাকে, বিড়ালটি আবার ভূতটুত হবে না তো? তিনি সব সময় বিড়ালটিকে লক্ষ করতে লাগলেন।

দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল। বিড়াল ছানাটি তখন আর ছানা রইল না, একটি বয়স্ক বিড়াল হয়ে উঠল সে। সবার থেকে আলাদা বিড়ালই হলো রিন্টুর। বিড়ালটি তরতর করে গাছে উঠে যেতে পারে, পানিতে সাঁতার কাটতে পারে, পুকুরে ডুব দিয়ে মাছ তুলে আনতে পারে। ঘরের ইঁদুর-তেলাপোকা রিন্টুর বিড়ালের হাত থেকে কিছুতেই নিস্তার পায় না। এসব দেখে মা আরো শংকিত হলেন। তিনি চোখে চোখে রাখতে লাগলেন বিড়ালটিকে।

হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে রিন্টুর মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিড়াল ছুটোছুটি করছে বুঝতে পারলেন তিনি। এবার তিনি মশারি থেকে মুখ বের করে মেঝের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন রিন্টুর কালো বিড়ালের সঙ্গে আরো অন্তত চার-পাঁচটি বিড়াল ছুটোছুটি করছে। প্রতিটি বিড়ালের চোখ লাল টকটকে। রিন্টুর মায়ের মনে খটকা লাগল। এ তো হতে পারে না! ঘরে তো একটিমাত্র বিড়াল থাকার কথা। আশেপাশে তো কোনো বিড়াল তিনি এতদিন দেখেননি! কালো বিড়াল কেন, অন্য কোনো রংয়ের বিড়ালও তিনি দেখেননি।

বিড়ালগুলি রিন্টুর মাকে দেখতে পেয়ে মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল। শূন্যে মিলিয়ে গেল বিড়ালগুলি। তিনি তাড়াতাড়ি রিন্টুর রুমে চলে গেলেন সেখানে রিন্টুর বিড়ালটি আছে কি না দেখার জন্য। না, কোথাও রিন্টুর বিড়াল নেই! তাহলে গেল কোথায়। তিনি আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। অবাক কা- সেখানে চার-পাঁচটি বিড়াল বসে আছে চুপচাপ। তাদের মধে রিন্টুর বিড়ালটিও আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে মানুষের মতো কথা বলছে। একটি বিড়াল বলছে আর কয়েকটা দিন তো, তারপর রিন্টুকে মেরে ফেলব। একটি বিড়াল জিজ্ঞেস করল তার আগে তোকে যদি ওরা মেরে ফেলে? রিন্টুর বিড়ালটি বলল, তা কী করে সম্ভব? ওরা তো জানে না, আমার মৃত্যু কেমন করে হবে। ওরা যদি তিনটি মরিচ পুড়িয়ে গুঁড়ো করে আমার শরীরে ছিঁটিয়ে দেয়, তাহলেই তো আমি মারা যাব। সে কথা তো তোরা ছাড়া আর কেউ জানে না, তাহলে আমাকে মেরে ফেলার তো প্রশ্নই আসে না।

সারারাত রিন্টুর মা আর ঘুমাতে পারলেন। তিনি সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রইলেন। খুব সকালে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলে রিন্টুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে রাতের সব ঘটনা রিন্টুকে খুলে বললেন। মায়ের কথা শুনে রিন্টু ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল আর ফিসফিস করে বলতে লাগল, তাড়াতাড়ি করো মাÑওই ভূতুরে বিড়ালটি এখনই মেরে ফেলো। 

রিন্টুর মা তিনটি শুকনো মরিচ চুলায় পুড়িয়ে গুঁড়ো করে ঘুমন্ত বিড়ালটির গায়ে যেই না ছিঁটিয়ে দিয়েছে, অমনি বিড়ালটি ছটফট করতে করতে মারা গেল। কিন্তু একি মৃত বিড়ালটি তো নেইÑবিড়ালের জায়গায় একটি কালো কাক মরে পড়ে আছে! 

রিন্টুর ভয় কেটে গেল। সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যিই মা আমার বিড়ালটি কিন্তু সবার থেকে আলাদাই ছিল। মা রিন্টুর কথা শুনে হেসে বললেন, সত্যিই তো। তোর বিড়ালটি একটি ভূতুড়ে বিড়াল ছিল!

প্রকাশিত গ্রন্থ : কালো বিড়াল লাল চোখ



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url