ফিরে এসো নীলাঞ্জনা []
সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। মেঘ-গর্জনের সঙ্গে ভারীবর্ষণ ও কালবোশেখির ঝড়োহাওয়া প্রকৃতিকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি, থামারও কোনো লক্ষণ নেই। ঘড়িতে রাত নটা। রিকশা না পেয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রাস্তায় নামে অমিত। শাহজাহানপুরের মেসে ফিরতে তার ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। শান্তিনগর থেকে শাহজাহানপুরের পুরো রাস্তা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও-কোথাও হাঁটুঅবদি পানি। অমিতের পায়ে নতুন জুতো। কয়েকদিন আগে টিউশনির টাকা পেয়ে সাদা রংয়ের একজোড়া কেডস কিনেছে সে। খুব পছন্দ হয়েছে জুতোজোড়া। জুতো রাস্তার কাদাপানিতে যাতে ভিজে না যায় সে জন্য ফিতে দিয়ে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে সে। একটি ইংরেজি মুভিতে এক তরুণকে গলায় জুতো ঝুলিয়ে পথ চলতে দেখেছিল সে। কানাডার এক তরুণ পরার জুতো গলায় ঝুলিয়ে ¯েœা-স্যু পায়ে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সময়টা ছিল শীতকাল। খুব তুষারপাত হচ্ছিল সেদিন। দৃশ্যটা অমিতকে অবাক করেছিল। আজ সেই তরুণের কথা মনে হওয়ায় আপন মনে হেসে ওঠে অমিত। মনে মনে ভাবে, প্রয়োজন শুধু আইন মানে না তা নয়, নতুন-নতুন বুদ্ধিরও জন্ম দেয়।
প্যান্ট যতটা উপরে উঠানো যায়, ততটা টেনে নিয়েছে হাঁটু পর্যন্ত। গায়ে টিশার্ট। অমিতের বড়ো-বড়ো চুল। তরুণ কবিরা যেমন রাখে। অমিত কবিতা লেখে না, তবে কবিদের মতো বেশভূষা পছন্দ তার। গদ্য মোটামুটি লিখতে পারে সে। অমিতের লেখা বেশ কয়েকটি ছোটোগল্প পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ফেসবুকসহ বেশ কয়েকটি অনলাইন মিডিয়ায় অমিত মোটামুটি পরিচিত। গাঁটের টাকা খরচ করে তথাকথিত সাহিত্য সংগঠন থেকে সার্টিফিকেট কেনার পক্ষে নয় সে। এ জন্য আজ পর্যন্ত লেখালিখির কোনো সার্টিফিকেট নেই তার। অমিত ওসব নিয়ে ভাবে না কখনো। অমিত মনে করে, ভালো লিখতে পারাটাই আসল। অমিত মাঝে-মধ্যে যে কবিতা লেখার চেষ্টা করে না, তাও নয়। তবে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারে না। আধুনিক কবিতার কোথায় ছন্দ ঠিক ধরতে পারে না সে। এক কবিবন্ধু অমিতকে বলেছে, ছন্দ না থাকলে কবিতা হয় না। আধুনিক কবিতার ছন্দটা দৃশ্যমান নয়, কিন্তু ছন্দ আছে; সেটা কোথায় অমিত তার মাথামু-ু কিছুই বুঝতে না পেরে নিজেকে নিজেই বলেছে, ‘কবিতা লেখা তোমার কাজ নয় অমিত!’
অমিতের বেশ কয়েকজন বন্ধু ঢাকা শহরে চাকরি করে, কেউ-কেউ ব্যবসা করে। এদের মধ্যে কয়েকজন বিয়ে করে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে দৌড়ে অমিত অনেকটা পিছিয়ে আছে। অমিত সবকিছুতেই পিছিয়ে থাকে। ঠিক কাজটি ঠিক সময়ে করতে পারে না সে কোনোদিনই। এ জন্য তার কোনো দুঃখবোধ নেই। অমিত মনে করে, মানুষকে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকা বলতে মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাকেই বোঝে অমিত। জীবনে প্রতিকূলতাকে জয় করার জন্য যুদ্ধ না থাকলে সে বেঁচে থাকা পানসে। কোনো মানে নেই সে জীবনের।
রাস্তা অন্ধকার। স্ট্রিট লাইটগুলো নিভে গেছে একটু আগে। ঘন-ঘন বজ্রপাত হওয়ায় বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অথবা ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে গেছে। শান্তিনগর থেকে শাহজাহানপুরÑএই পথটা অমিতের প্রতিদিনের চেনা। তবুও খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে তাকে। অন্ধকারে একা চলতে ছিনতাইকারী ও পকেটমারের ভয় থাকে। পকেটমার নিয়ে খুব একটা ভাবে না অমিত। তার পকেটে বাসভাড়া ছাড়া বাড়তি টাকা কখনোই থাকে না। তবে অমিতের দু-দুটো ঘড়ি বাসে চুরি হয়েছে। খুব কষ্ট করে টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে ঘড়ি কিনেছিল সে। জগতে কোনো কিছুর প্রতি অমিতের মোহ নেই, ঘড়ি ছাড়া। দু-দুটো ঘড়ি হারিয়ে ঘড়ি কেনার আর ইচ্ছে হয়নি তার, সামর্থও নেই অমিতের। একটি টিসর্ট ঘড়ি কেনার খুব ইচ্ছে আছে অমিতের। ছোটবেলায় বাবাকে টিসর্ট ঘড়ি পরতে দেখেছে সে। অমিতের মেজো মামা ঘড়িটি কিনে দিয়েছিলেন বাবাকে। বাবা ঘড়ি খুব একটা পরতেন না। ঘড়ি পরে অফিসেও যেতেন না। অফিসে ওয়াল ঘড়ি দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন বাবা।
অমিতের বাবা একটি ব্যাংকে চাকরি করতেন। তখনকার দিনে এখনকার মতো ব্যাংকে অতটা ভিড় হতো না। বাবা বাসায় ঘড়িটা রেখে অফিসে গেলে অমিত ঘড়িটি নিয়ে ভাবত সেও একদিন এমনই একটি ঘড়ি কিনবে। অমিত যেবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে, বাবা তাকে একটি ওমেগা ঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন। ঘড়িটি সে ফিরিয়ে দিয়েছিল সময় ঠিক থাকে না, ফার্স্ট হয় বলে। অমিত বলেনি টিসর্ট ঘড়ি তার পছন্দ। অত টাকার ঘড় কিনে দিতে না পেরে পাছে বাবা কষ্ট পান, সেই ভয়ে।
বাবা তার ঘড়িটা নিজের করে রাখতে পারেননি। বড়ো মেয়েজামাই একদিন ঘড়িটি চেয়ে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। বাবার হাতের ঘড়িটি না থাকায় অমিত খুব কষ্ট পেয়েছিল। বাবাও যে কষ্ট পাননি তা নয়। তবে প্রকাশ করেননি কখনো। বাবারা কখনো দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ করতে পারেন না বা করেন না, সন্তান কষ্ট পাবে বলে বাবারা নীলকণ্ঠ হয়! সংসারে সবার দুঃখ-কষ্টকে নিজের করে নিয়েই যেন বাবাদের সুখ। বাবারা নিজের আগে অন্যের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেন বেশি। সে কথা কেউ মনে রাখে না! অমিত পথ চলতে-চলতে ভাবে সেও কি বাবার মতো হতে পারবে। বাবার কোনোকিছুতে রাগ নেই, অভিমান নেই, কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেইÑএমনটা কি হবে সেও? বাবার এই গুণগুলো কি রপ্ত করতে পারবে সে? অমিতের সন্দেহ হয়, সে পারবে না। বাবার মতো অত ধৈর্য তার নেই।
এসব ভাবনার মধ্যে একটি প্রাইভেট কার এসে অমিতের গাঘেঁষে দাঁড়ায়। অমিত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ড্রাইভিং সিট থেকে ড্রাইভার জানালা খুলে জানতে চায় অমিত কোথায় যাবে। অমিত কোনো উত্তর দেয় না। গাড়ির ভিতর লাইটের আলোয় অমিত দেখতে পায় বেশ সুন্দরী এক নারী পিছনের সিটে বসে আছে। তাকে দেখে খুব চেনা-চেনা লাগে অমিতের। মনে হয় কোথায় যেন দেখেছে তাকে। কিন্তু কোথায়Ñমনে করতে পারে না সে। গাড়িটি একটু সময় অপেক্ষা করে আবার চলতে শুরু করে। অমিতও আবার নিজের পথ ধরে এগিয়ে যায়, তবে এসব মাথা থেকে তাড়াতে পারে না সে। কোথায় দেখা হয়েছে মহিলার সঙ্গে, সেই হদিস খুঁজতে-খুঁজতে হঠাৎ কিছু একটার সঙ্গে অমিতের ধাক্কা লাগে। রাস্তায় পড়ে যায় সে। পুরো শরীর ময়লা পানিতে ভিজে যায়। সেদিকে তার খেয়াল নেই। মনে মনে ভাবে, যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে শরীরের ময়লা পানি ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাবে। অমিত অলওয়েজ পজেটিভ চিন্তা করতে অভ্যস্ত। সব খারাপের মধ্যে একটি ভালো দিক থাকে, অমিত সেটা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।
বেকার যুবক অমিত। এই শহরের আরও হাজার-হাজার শিক্ষিত বেকারের মধ্যে সেও একজন। মাস্টার্সের রেজাল্টের পর দশ বছরেও অমিত কোনো চাকরিতেই স্থায়ী হতে পারেনি। অনিশ্চিত প্রাইভেট চাকরি ও টিউশনির আয় দিয়ে চলতে হয় তাকে। কতদিন আর টিউশনি করে চলবে জানে না সে। মাস শেষে মেসের ভাড়া ও খাওয়ার টাকা ছাড়াও ছোটবোনের লেখাপড়ার খরচ পাঠাতে হয় বাড়িতে। সব মিলিয়ে হাজার দশেক টাকা দরকার তার। আপাতত দুটি টিউশনি থেকে সাড়ে বারো হাজার টাকার মতো আসে। এতে কোনোরকম চলে গেলেও ঝুঁকি তো থাকেই। যে কোনো সময় টিউশনি চলে যেতে পারে। অমিত ভাবে যে করেই হোক শিগগিরই তাকে একটি স্থায়ী চাকরি যোগার করে নিতে হবে। আপাতত প্রাইভেট চাকরিই ভরসা, সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়ে গেছে তার।
হঠাৎ অমিতের সেল ফোন বেজে ওঠে। এর মধ্যে আরও কয়েকবার রিং হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে মোবাইল সেট বের করা সম্ভব হয়নি। অমিত বন্ধুদের আড্ডা থেকে বের হওয়ার সময় পলিথিন কাগজে পেঁচিয়ে মোবাইল সেট প্যান্টের পকেটে রেখেছে। কমদামী বাটন ফোন। এতেই চলে যায় তার। বন্ধুরা তাকে একটি এনড্রয়েড ফোন কিনতে বলে। তারও ইচ্ছে আছে। কিন্তু টাকার জন্য কিনতে পারছে না সে। বেশ কয়েকবার সে দোকানে গিয়ে বিভিন্ন ব্রান্ডের ফোন দেখে এসেছে। কম করে হলেও পাঁচ হাজার টাকা না হলে ও ধরনের ফোন কেনা সম্ভব নয়। ফোন কেনার জন্য অনেকদিন ধরে টাকা জমিয়ে আসছে সে। বইয়ের ভাঁজে-ভাঁজে পাঁচ-দশ টাকা করে জমায়। সিগারেটের বাজে অভ্যাস আছে অমিতের। কিছুতেই ছাড়তে পারে না। টাকায় কুলায় না দেখে খুব কম দামী সিগারেট খায় সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সারা নামের একটি মেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল কম দামি সিগারেট কেন খায় অমিত। সারা অমিতের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। সারার সঙ্গে অমিতের সম্পর্কটা ছিল অন্যসব মেয়েবন্ধু থেকে একটু আলাদা। নিছক বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সারা ছিল বিবাহিতা। এ কারণে ওর প্রতি ক্লাসের অন্য ছেলেদের আকর্ষণ ছিল না। সারা ছিল বেশ সুন্দরী ও স্মার্ট। মেয়েরা খুব সহজেই মানুষের মন পড়তে পারে। অমিত ছাড়া অন্যদের কাছে সারার খুব একটা দাম নেইÑএটা বুঝতে পারত সারা। ক্লাসে ঝিনুকের সঙ্গে অমিতের সম্পর্কটা কেমন যেন গায়েপড়া ছিল। ঝিনুক চাইত সব সময় অমিতের পাশাপাশি বসতে, একসঙ্গে গল্প করতে। অমিত তাকে এড়িয়ে যেত। একদিন সন্ধ্যায় ঝিনুক অমিতকে বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করে বলেছিল, ‘এসো কিন্তু, সন্ধ্যার মধ্যে চলে এসো। দুজনে গল্প করব; বাসায় কেউ নেই।’ ঝিনুকের কথা শুনে অমিত চমকে উঠেছিল, খুব বাজের একটা ইঙ্গিত আছে ঝিনুকের কথায়, অমিতের মনে হয়েছিল। তারপর থেকে ঝিনুককে অমিত এড়িয়ে যেতে থাকে।
বৃষ্টি থেমে গেছে হঠাৎ করে। রাস্তার লাইটগুলোও জ্বলে উঠেছে। হেঁটে মেসে পৌঁছতে আরও মিনিট দশেক লাগতে পারে। পকেটের মোবাইল ফোন আবারও বেজে উঠলে সেট বের করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সেÑ‘এতক্ষণে তাহলে বাসায় পৌঁছতে পেরেছ?’
অমিত সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, ‘না। এখনো পারিনি। কিন্তু আপনি কে?’
‘আধাঘন্টা আগে তোমার পাশে যে ছাইরঙা গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। ড্রাইভার তোমাকে গাড়িতে ওঠার কথা বলেছিল...’
‘ওঃ তাহলে আপনি ছিলেন গাড়িতে!’ অমিত বলল।
‘তুমি তো আমাকে দেখতে পেয়েছিলে, চিনতে পারনি কেন?’
অমিত বলল, ‘চিনতে পারিনি, এটা ঠিক। আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন?’
‘বলছি এ জন্য যে, আমি তোমাকে চিনি। আমরা এক সময় তুমি-তুই করেই বলতাম। এখন থেকে আর আপনি বোলো না।’
‘কিন্তু আমি তো চিনতে পারিনি! তুমি কী করে বলি?’ অমিত বলল।
‘নতুন করে পরিচিত হতে হবে বুঝি?’
অমিত একটু ভাবল। এর মধ্যে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলল, ‘ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে।’
‘আপনার ধারণা অমূলক নয়। কেননা অত রাতে অপরিচিত কোনো নারী কাউকে গাড়িতে ওঠার প্রস্তাব দিলে সেটাকে রহস্যপূর্ণ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। রহস্য মানেই তো অন্ধকার। আমি অন্ধকারকে ভয় পাই। আপনি ভয় পান না?’
‘সত্যি কথা বলব?’
‘সেটা আপনার ইচ্ছে। সত্যি বা মিথ্যে যেটাই বলুন না কেন, আমি খুব স্বাভাবিকভাবে আপনার কথাগুলো নিতে পারছি না। আমি মেসের গেটে চলে এসেছি। রাখছি।’ অমিত লাইন কেটে দেয়।
অমিত মেসে গিয়ে হিন্দি গান শুনতে পায়। অমিতকে দেখে রউফ সাহেব হিন্দি গান বন্ধ করে রবীন্দ্র সঙ্গীত চালু করে। রউফ সাহেব অমিতের রুমমেট। বয়স অমিতের চেয়ে দশ-পনেরো বছর বেশি। রউফ একা-একা কখনো রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনে না। অমিতকে খুশি করার জন্য সে রবীন্দ্রনাথের গান বাজায়। আজীবন অকৃতদার এই লোকটি নিজের চেয়ে অন্যকে খুশি করাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। এই মেসেই দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছে সে। একটি বেসরকারি অফিসের বিল কালেক্টরের কাজ করে। অফিসে তার কোনো বদনাম নেই, আবার সুনামও নেই। কেউ তার বিশেষ বন্ধুও নয়, আবার শত্রুও নয়। সমালোচিত না হলে কারো গুরুত্ব বাড়ে না। রউফের সমালোচনা করার মতো কিছু নেই। কারো বিশেষ কোনো গুণ থাকলে অনেকে তাকে সমালোচনা করে, এটা মানুষের স্বভাব। রউফের বিশেষ গুণ বলতে কিছু নেই। সবার সঙ্গে হেসে কথা বলা, যখন-তখন যে কাউকে চায়ের আমন্ত্রণ জানানো তার স্বভাব। এতে কারো ক্ষতি বা হিংসা হয় না। বরং খুশিই হয়। সুতরাং তার কোনো শত্রু নেই, মিত্রও বিশেষ কেউ নেই।
‘একেবারে ভিজে এলেন!’ রউফ এতক্ষণ শুয়েছিল। অমিত ঘরে ঢুকলে উঠে বসল। অমিতের আপদমস্তক লক্ষ করে বলল, ‘হায়-হায় একেবারে তো ভিজে এসেছেন! তাড়াতাড়ি কাপড় বদলান। না হলে ঠান্ডা লাগতে পারে। ঠান্ডা লাগলে নিউমোনিয়া হতেও তো পারে। জানেন, আমার এক ফুফাত ভাই বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। আহা বেচারা মাত্র দুমাস হয় বিয়ে করেছিল!’ রউফ কথায়-কথায় মুত্যুর কথা বলে। বয়স হলে অনেককে মৃত্যুচিন্তায় পেয়ে বসে। রউফ সাহেবের মৃত্যুর আতঙ্ক আছে। প্রায় প্রতিদিন রাতে সে মৃত ব্যক্তিদের স্বপ্নে দেখে। রউফ বলে, মৃত ব্যক্তিরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। খুব শিগগিরই তারও চলে যেতে হবে। না হলে ওরা আসে কেন!
রউফ সাহেবের ফুফাতো ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ ও ঘটনা বার বার শুনে বিষয়টি মুখস্ত হয়ে গেছে অমিতের। তবুও প্রসঙ্গটি উঠলে অমিত আগ্রহ দেখায়। অন্যকে কথা বলতে সুযোগ দিতে চায় অমিত। এতে বন্ধুত্বটা পাকা হয়।
‘বলেন কী!’ বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়ায় মারা গেলেন?’ অমিত অবাক হয়ে বলে, যেন সে এর আগে এসবের কিছুই জানে না।
‘এসব কথা পরে হবে অমিত সাহেব। তার আগে আপনার ভেজা কাপড় পাল্টানো খুব জরুরি।’
অমিত সে কথা জানে যে ভিজে কাপড়ে থাকলে জ্বর হতে পারে। ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়াও হতে পারে। হবেই যে, এমন কোনো কথা নেই। মানুষ এসব দৈব বলে মনে করে। বিশ্বাস করলে নন্দলাল হয়ে ঘরে বসে থাকবে সবাই। অমিতের এক বোন স্কুলে পড়া অবস্থায় মাত্র তিনদিনের জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল। নিউমোনিয়া কি না জানে না অমিত। জানার চেষ্টাও করেনি পরিবারের কেউ। তবে কারো মৃত্যুর কথা শুনলে অমিতের খুব খারাপ লাগে। এসব ঘটনা সব সময় এড়িয়ে চলে সে।
‘আপনার ফুফাতো ভাইয়ের ঘটনাটা শুনব রউফ ভাই। তার আগে আমি কাপড় বদলে আসছি।’ অমিত বলল।
‘আরে আমিও তো তাই বলছি। আগে ফ্রেশ হয়ে নিন। আপনার তো খাওয়াও হয়নি। দুজনে খেতে খেতে না হয় গল্প করা যাবে।’
অমিত মন খারাপ নিয়ে ওয়াশরুমে যায়। একটু পরে ভেজা জামা-কাপড় পাল্টে বেরিয়ে এসে নিজের সিটে বসতে-বসতে বলে, ‘আপনি এখনো রাতের খাওয়া খাননি বুঝি?’
রউফ উত্তর দেয় না। কিছুটা হাসে। হাসিতে কী বোঝাতে চেয়েছে অমিত বুঝতে পারে না। হাসির অনেক রহস্য থাকে, সে রহস্য ভেদ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। সবাই তা পারে না। ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতেই অমিতের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে অপরিচিত নম্বর দেখে এড়িয়ে যায় অমিত। ফোন ধরার আগ্রহ নেই তার।
‘ফোন ধরছেন না কেন অমিত সাহেব?’ রউফ জিজ্ঞেস করলে অমিত বলে, ‘অপরিচিত নম্বর। কে-না কে! বিশেষ প্রয়োজন হলে আবার করবে নিশ্চয়ই।’
রউফ সাহেব অবাক হয়ে বলে, ‘আননোন নম্বর বলে ধরবেন না? তা কী হয়! কতজনের কত প্রয়োজন থাকতে পারে আপনার সঙ্গে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কি কাউকে ফোন করে? আচ্ছা মনে করুন, আপনারও তো কাউকে প্রয়োজন হতে পারে, যার কাছে আপনার নম্বর সেভ করা নেই।’
রউফের সাহেবের কথার গুরুত্ব বুঝতে পারে অমিত। মাথা নেড়ে বলে, ‘সত্যি বলেছেন। আচ্ছা আবার এলে না হয় ধরা যাবে।’
‘সেটাও কি ঠিক? ফোন ধরতে পারেননি বলে আপনি কি কলব্যাক করতে পারেন না? সেটাই তো হওয়া উচিত।’
অমিত মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বলে, ‘একদম ঠিক বলেছেন রউফ ভাই। আপনাদের মতো সিনিয়রদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।’
রউফ সাহেবকে কেউ সিনিয়র বললে খুব খুশি হয়ে বলে, না, আমি তো তেমন নই! হাসতে-হাসতে ভদ্রতা করে বলে, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড, সেটা মানি। তবে আমি তো সিনিয়র হতে পারিনি এখনো!’
অমিত মাথা নেড়ে রউফ সাহেবকে সমর্থন করে মোবাইলের রিসেন্ট কললিস্ট থেকে একটু আগে আসা নম্বরে ফোন করে। একবার-দুবার রিং হতেই ও-পাশ থেকে খুব অভিযোগের সঙ্গে বলে, ‘এতক্ষণ ফোন বাজল, কেন ধরলে না?’
অমিত রেগে যায়। ‘সবার ফোন সব সময় যে ধরতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া আপনার নম্বর আমার সেভ করা নেই, তাই ধরিনি। পরে আমিই তো কলব্যাক করলাম। তাহলে কেন অভিযোগটা করলেন?’
‘তোমাকে আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি অমিত।’
‘এবার পরিচয়টা দিন অন্তত।’
‘তুমি তো মাস্টার করেছ বছর দশেক হলো। এর মধ্যে সব ভুলে গেলে?’
‘কে তুমি?’
‘গেজ করো। হা-হা তুমিও তো তুমি করে বললে!’
‘প্রতিশোধ নিলাম!’
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বেশ জোরে হাসির শব্দ পাওয়া গেল। ‘প্রতিশোধ? প্রতিশোধ তো নেব আমি...।’
‘তা নিয়ো। তবে এখন ফোন রাখছি। অপরিচিত কারো সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে ভালো লাগে না আমার।’
‘লাইন কেটে দিলে লাভ হবে না। আমি আবারও ফোন করতে পারি। এতদিন তোমার নম্বর জানা ছিল না। গত দুদিন আগে তোমার ঠিকানা ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছি।’
‘ধন্য করেছ! একটু আগে তুমিই কি ফোন করেছিলে?’
‘কণ্ঠস্বরে চিনতে পারোনি? পারবে কেন? তুমি বরাবরই ওরকম। গুড ফর নাথিং। হোক না গাড়িতে আবছা আলো, তুমি চিনতে পারলে না আমাকে? অথচ...’
‘কী?’
‘অথচ অন্ধকারে বৃষ্টিভেজা তোমাকে দেখে আমি ঠিকই চিনে নিয়েছি। তুমি কিন্তু একটুও বদলাওনি অমিত।’
‘ফোন রাখছি আমি।’ অমিত বলল।
‘আমার পরিচয়টা জানবে না?’
‘আমার একেবারেই আগ্রহ নেই।’ ফোনের লাইন কেটে দিলো অমিত।