ফিরে এসো নীলাঞ্জনা [২]

 
দুই

মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্টের পর কারো নৈতিক অধিকার থাকে না হলের সিট দখল করে রাখার। তবে অনেকেই সে নিয়ম না মেনে মাসের পর মাস হলে থেকে যায়। যে যাই করুক, রেজাল্ট পাওয়ার পরের দিনই অমিত হলের রুম ছেড়ে দিয়েছিল। এ জন্য বন্ধুদের অনেকের সঙ্গে ঠিকানা বা ফোন নম্বর আদান-প্রদান সম্ভব হয়ে ওঠেনি তার। তবে অনেকের ফোন নম্বর অমিতের কাছে যেমন আছে, তেমনি অমিতের নম্বরও বন্ধুদের কারো-কারো কাছে আছে। 

অনার্সে ভর্তির ছয় মাসের মাথায় অমিত জানতে পারে তার বাবা হঠাৎ আরেকটি বিয়ে করেছেন। তার পরপরই বাবা জানিয়ে দেন তার পক্ষে অমিতের জন্য আর টাকা পাঠানো সম্ভব নয়। খবরটা শোনার পর বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল অমিত, বাবাকে কিছু বলার জন্য নয়Ñমায়ের কথা চিন্তা করে। বাড়িতে গিয়ে দেখে বাবা সবাইকে ছেড়ে নতুন করে সংসার শুরু করেছেন। বিষয়টি অমিতকে ব্যথিত করলেও একেবারে হতাশ হয়ে পড়েনি সে। অভিমান করে বাবার সঙ্গে দেখা না করেই ঢাকায় চলে এসেছিল। আসার সময় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অমিত আর কিছু বলতে পারেনি। মা শুধু বলেছিলেন, তোর লেখাপড়ায় যেন ক্ষতি না হয়। দরকার হলে ঢাকায় আত্মীয়-স্বজন আছে, তাদের সাহায্য নিস। অমিত কারো সাহায্য নিতে যায়নি।

ঢাকায় ফিরেই সে এক বন্ধুর মাধ্যমে দু-তিনটা টিউশনি যোগার করতে পেরেছিল। শেখ সাহেবের বাজারে ছোটো একটি প্রেসে পার্টটাইম প্রুফ দেখার কাজও পেয়েছিল অমিত। সব মিলিয়ে চলার মতো টাকা রোজগার হতো টিউশনি ও চাকরি থেকে। নিজের পড়াশুনা ও বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি তার।

মাস্টার্স শেষ করেই চাকরির জন্য হন্যে হয়ে এখানে-সেখানে ছোটাছুটি করেও কোনো কিছু করতে না পেরে শেষমেশ টিউশনির ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে তাকে। দুবছরের মধ্যে ছোটো দুবোনের বিয়ে হয়ে যায়। শুধু সংসার খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে হয় মাকে। অমিতের বড়ো ভাই সংসারের যাবতীয় খরচ যোগান। তবে তার একার পক্ষে সবটা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না বলে অমিতকে ভাবতে হয়।

খেতে বসে এসব কথা ভেবে অমিত কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে রউফ বলল, ‘আপনি কি কিছু ভাবছেন অমিত?’ 

‘না, তেমন কিছু না। খুব ব্যক্তিগত বিষয়।’

‘আপনি তো নিজের কথা কিছুই বলেন না! আমিও জানতে চাই না। আপনার ব্যক্তিগত বিষয় আমাকে না বললে গায়ে পড়ে জানতে চাওয়াটা ঠিক নয়। তবে অমিত সাহেব, আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন। জীবনে বড়ো কিছু হতে পারিনি সত্যি, এ কারণে কাউকে বড়ো কোনো উপকার করাও সম্ভব হয়নি। তবে অন্তত বুদ্ধি বা পরামর্শ করে তো সমাধান বের করা যায়। অনেক দিন ভেবেছি, আপনাকে বলব। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। দেখুন আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমি যদি আপনার সমস্যার সামান্যতম সমাধান করতে পারি, তাহলে নিজেকে খুব ধন্য মনে করব।’

রউফের কথা শুনে অমিতের দুই চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। সে তা লুকাতে পারে না। রউফ তা দেখে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে।

‘আমি কি আপনাকে কোনো ব্যাপারে কষ্ট দিলাম? সে রকম হলে ক্ষমা করে দিবেন।’ খুব স¯েœহে কথাগুলো বলল রউফ।

‘না না, আপনি অমন ভাবছেন কেন? আপনি আমাকে কষ্ট দেননি। তবে আপনার কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি আমি। এত দরদ দিয়ে কথা বলার কেউ নেই  আমার!’

চোখ মুছে অমিত বলে, ‘আমার অনেক ব্যক্তিগত কষ্ট আছে রউফ ভাই। আপনি আমার বড়ো ভাইয়ের মতো। আজ আপনি স¯েœহে যে কথাটা বললেন, সে রকম আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি। অনার্সে পড়ার সময় বাবা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেও পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে। একমাত্র টিউশনির টাকায় আর কতটা পারা যায় বলুন? বাড়িতে মায়ের হাতে কিছু টাকা দেওয়া, ছোটো বোনের পড়াশুনার কিছুটা খরচ পাঠিয়ে নিজেকে খুব কষ্ট করে চলতে হয়েছে। হলে থাকতে কতদিন যে না খেয়ে থেকেছি, সে হিসাবটা আমিই জানি না।’

রউফ সাহেব অবাক হয়ে বলেন, ‘কী বলছেন আপনি? ঢাকায় কোনো আপনজন নেই আপনার?’

‘হ্যাঁ, অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে। তারা অনেকেই বড়োলোক। তারা ইচ্ছে করলে রাতারাতি আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারতেন। যাইনি, যেতে ইচ্ছে হয়নি আমার। 

‘এটা আপনার ভীষণ অন্যায়। বিপদের সময় আত্মীয়-স্বজনের কাছে আপনার যাওয়া উচিত ছিল।’

‘গেলেই যে তারা আমার জন্য কিছু করবে, বিশ্বাস হয়নি আমার।

‘কেন?’

‘অনার্সে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। ডাইনিং বন্ধ। হাতেও টাকা নেই বাড়িতে যাওয়ার। তাছাড়া বাড়িতে গিয়েও-বা কী করব? তখন এক চাচার কাছে ছুটি গিয়েছিলাম মাত্র একশত টাকা পাওয়ার জন্য। তিনি আমাকে দেননি টাকাটা! সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে যতদিন বাঁচব না খেয়ে মরে গেলেও কারো কাছে হাত পাতব না।’

‘এটা আপনার অভিমানের কথা। সবাই তো একরকম নাও হতে পারে। কেউ না কেউ তো আপনার কষ্টটা বুঝতে পারত।’

‘অন্যকে বিব্রত করে কী লাভ বলুন? হয়তো আমার কষ্ট বুঝতে পারত। যদি না বুঝত, যদি একশত টাকার মতো না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো অন্য আরো কেউ একই আচরণ করত, তখন কি আমার কষ্টটা আরো ভারী হতো না?’

রউফ কিছুটা ভেবে বলল, ‘আপনার তো সরকারি চাকরির বয়স চলে  গেছে। এখন প্রাইভেট চাকরির নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’

অমিত হেসে বলল, ‘সরকারি চাকরি করার কোনো ইচ্ছে নেই রউফ ভাই। আর সে ধরনের চেষ্টাও করিনি কখনো।’

‘বলেন কি! সরকারি চাকরি করার জন্য সবাই পাগল। আর আপনি এমন করে বলছেন কেন?’

‘খুব সহজ। সরকারি চাকরিতে বেতন কম। এ কারণে প্রায় সবাইকে ঘুস খেতে হয়। এটাকে খুব গর্হিত কাজ মনে হয় আমার। আমি সেটা পারব না। তার চেয়ে প্রাইভেট চাকরিই ভালো। ওখানে অন্যায় করার কোনো স্কোপ থাকে না।’

‘আপনি খুব আদর্শবান অমিত সাহেব। তবে কি জানেন, প্রয়োজন কোনো আইন মানে না।’

‘সে আমি জানি রউফ ভাই। জীবন তো খুব একটা বড়ো নয়। একটি কচ্ছপ পাঁচশত বছর বাঁচে। আর আমাদের মাত্র পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছরের জীবন। একবার ভেবে দেখুন, লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে তিরিশ বছরের মতো চলে যায়। এরপর বিয়ে করে সংসার গুছাতে-গুছাতে আরও দশ বছর। তাহলে আর বাকি থাকল কী। জীবন তো এতটুকুই। এইটুকু জীবনের জন্য অনৈতিকভাবে টাকা-পয়সা রোজগার করে জীবনে সুখ পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি না।’

রউফ সাহেব অবাক হয়ে অমিতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে-আস্তে বলে, ‘বিয়ে করবেন না? সংসারী হতে ইচ্ছে করে না?’

‘ইচ্ছে থাকবে না কেন? সবার মতো আমারও সেটা আছে। তবে কি জানেন, স্ত্রী-পুত্র তো একটা মোহ বই আর কিছু নয়। হাচন রাজার গানটা শোনেননি, ওই যে তিনি একটি গানে বলেছিলেনÑ

‘স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি

পুত্র হইল খিল

কেমনে করিবে হাচন

বন্ধের সঙ্গে মিল!’ 

‘তবুও তো মানুষ সংসারী হয়! সেই সংসার জীবনে সে যদি কিছু না পায় তাহলে কেন মানুষ এত কষ্ট করে?’

‘আপনার এই প্রশ্নটির উত্তর আমার জানা নেই। একটা বিষয় লক্ষ করুন, যে মানুষটি চরম দরিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, সেও বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আচ্ছা বলুন তো, সন্তানরা যখন বড়ো হয়ে ওঠে, লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি করে, তখন সেই সন্তান কি একবারও বাবা-মায়ের দিকে লক্ষ রাখে বা রাখতে পারে? তারা কি কখনো ভাবে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের যখন শরীরে শক্তি থাকে না, আয়-ইনকাম করার সামর্থ থাকে না, তখন কি সন্তান মাকে-বাবাকে একটু নিশ্চিন্তে রাখার জন্য ভাবে? সে যতটা বাবা-মাকে নিয়ে ভাবে, তার চেয়ে বেশি ভাবে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। অথচ এই বাবা-মাই একদিন খেয়ে না-খেয়ে তাকে বড়ো করেছে, ভবিষ্যতের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো করে তৈরি করতে সবকিছু বিসর্জন দিতেও এতটুকু কুণ্ঠা করেনি!’

অমিতের কথা শুনে খুবই বিমর্ষ হলো রউফ। বলল, ‘সত্যিই তো এরকম তো ভাবিনি!’

‘করোনার সময়ের কথা মনে আছে আপনার, যখন অতিমারিতে ভেঙ্গে পড়েছিল আমাদের সামাজিক জীবন। সেদিনের কথাগুলো মনে করে দেখুন, করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে সন্তান তার বাবা-মাকে ঘর থেকে বের করে গাছতলায় ফেলে রেখে এসে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখি হতে চেয়েছিল। তখন কিন্তু একবারও ভাবেনি, তার এই জীবনের জন্য বাবা-মায়ের একমাত্র অবদানের কথা। ঈশ্বরের কথা যদি বলেন, তিনি অলক্ষে থাকেন, হয়তো মৃত্যুর পর বিচারও করবেন, কিন্তু তাতে কী! ওই যে অসহায় বাবা-মা তো জীবনে কিছুই পেলেন না! তাকে তো সংগ্রাম করতে-করতে এবং আশায়-আশায় থেকে  পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো। জানেন রউফ ভাই, জীবনে প্রত্যাশার চেয়ে খারাপ কিছু নেই। কারণ প্রত্যাশা কখনোই আপনার মতো হবে না। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে করুন, তিনি বলেছিলেনÑ

‘যা কিছু পাই, ভুল করে পাই,

যা কিছু চাই তা পাই না।’

হুমায়ূন আহমেদের একটি কথা স্মরণ করে দেখুন, তিনি বলেছিলেনÑ


‘ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া

জোছনা ধরতে যাই;

হাত ভর্তি চান্দের আলো

ধরতে গেলে নাই!’

আমি জানি, যে জীবনে প্রত্যাশা নেই, সে জীবন মানুষের নয়। তারপরও আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি মনে করি, কর্তব্যটুকুই আসল। আপনার প্রতি আমার যেটুকু কর্তব্য, সমাজের প্রতি যতটুকু দায়, গাছের প্রতি, পাখির প্রতি যতটুকুু ভালোবাসা যতটুকু, ততটুকুই খাঁটি, বাকি সবই মেকি। মেকি জীবনের প্রতি কোনো মোহ নেই আমার। বিয়ে করব বলে ভাবিনি কখনো। করলেও যতদিন বাবা-মা বেঁচে থাকবেন, ততদিন অন্তত নয়। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব-করব বলে করা হয়নি।’

‘কী?’

‘আপনি কেন বিয়ে করলেন না?’

কথা বলতে-বলতে দুজনের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অমিতের কথার উত্তর না দিয়ে হাত ধোয়ার জন্য উঠে পড়ল রউফ। তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে নিজের বিছানায় গিয়ে বসে খুব কমদামী একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘বিয়ে করতে চাইলেই কি বিয়ে করা যায়?’

‘হয়তো না। তবে আমি যতটুকু আপনাকে জানি আপনি চাকরি না করলেও চলে আপনার। পৈতৃক সম্পত্তি আপনার কম নয়, সে কথা আপনিই একদিন বলেছিলেন আমাকে। বিয়ে করার যতটা উপকরণ দরকার, তার কোনো ঘাটতি আপনার নেই। তবুও আপনি সংসারী হলেন না। একা-একাই একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা কী?’

‘আমার দেওয়া ব্যাখ্যা আপনার পছন্দ নাও হতে পারে। তবে বিয়ে না করার পিছনে আমার একটি আবেগ জড়িয়ে আছে। আপনি যেমন বললেন, প্রত্যাশা মানুষের শত্রু, আমি তার সঙ্গে যোগ করে বলতে চাই আবেগও মানুষের কম শত্রু নয়। আমি আবেগে অন্ধ হয়ে আছি অমিত সাহেব। আবেগ আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমি আর সামনের দিকে এগুতে পারছি না।’

অমিত রউফ সাহেবের কথা বুঝতে না পেরে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রউফ সাহেব উঠে গিয়ে নিজের অ্যালবাম থেকে একটি ছবি এনে অমিতের হাতে দিয়ে বলে, ‘এই মেয়েটি আমাকে নিঃস্ব করে রেখেছে!’

‘আপনি ভালোবাসতেন একে?’

‘বাসতাম না, এখনও বাসি। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন ওকেই ভালোবেসে যাব। ওর জন্য আমার হৃদয়ে যে আসন পেতে রেখেছি, সে আসনে আমি অন্য কাউকে বসাতে পারব না বলে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারছি না আমি।’

‘মেয়েটি কি আপনার সঙ্গে প্রতারণা করেছে?’

‘প্রতারণা করলে তো বেঁচে যেতাম, না তা করেনি।’

‘তাহলে?’

‘ও বেঁচে নেই। আত্মহত্যা করেছে। আমাকে না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা সহপাঠী ছিলাম। দীর্ঘ দশ বছর ছিল আমাদের প্রেম। ওর পরিবার ওর ভালোবাসার মর্যাদা না দিয়ে জোর করে বিয়ে দেয় ওকে। ফুলশয্যার রাতেই জুঁই আত্মহত্যা করে!’

‘বলেন কী!’

‘যে মানুষটি আমাকে না পেয়ে নিজেকে উৎসর্গ করল, তার জন্য আমি কি কিছুই করব না? তার জায়গায় কী করে অন্য একজনকে বসাব বলতে পারেন?’ কথা বলতে-বলতে দুই চোখ আর্দ্র হয়ে উঠলে চোখ মুছে রউফ বলে, ‘দেখতে-দেখতে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেছি। গত পঁচিশটা বছর আমি ওর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। বাকিটা জীবনটাও ওকে নিয়ে বাঁচতে চাই। ওর একটি ছবি সব সময় আমার মানিব্যাগে থাকে। যখন-তখন ওর ছবির সঙ্গে কথা বলি। সত্যি কথা বলতে কি জানেন অমিত সাহেব, প্রায় প্রতিরাতে ওকে স্বপ্নে দেখি আমি। সাদা শাড়ি পরে সুগন্ধী মেখে জুঁই আমার কাছে আসে। আমরা আমাদের সুখ-দুখের কথা বলি। একদিন কী হলো জানেন?’

‘কী?’

‘শুধু একদিন, একদিনই জুঁই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওর বুকে আমি সেই পুরোনো গন্ধটা পেয়েছিলাম। তারপর থেকে পরিচিত সেই গন্ধটা প্রায়ই নাকে এসে লাগে। বিশ্বাস করুন, এই মুহূর্তে আমি বেলী ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। এরপর একদিন ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে কী বলেছিল জানেন?’

‘কী?’

‘বলেছিল আর মাত্র দশটা বছর পর আমরা একত্রিত হব। যেদিন আমার নশ্বর দেহটা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, আমার এবং ওর আত্মার মিলন হবে সেদিন।’

‘দশ বছর?’

‘আর মাত্র দশ বছর বাঁচব আমি। জুঁই সে কথা বলেছে আমাকে।’

‘আপনি সেটা বিশ্বাস করেন?’

‘ওই যে কথায় বলে না, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। অমিত সাহেব, প্রেম হচ্ছে স্বর্গীয়। ভালোবেসে বিয়ে করে সংসারের জটিল আবর্তে  প্রেমকে ডুবিয়ে মারলে সেটা আর স্বর্গীয় থাকে না। বিয়ে প্রেমের সমাধি রচনা করে। আমি জুঁই ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। আচ্ছা আপনি কি কাউকে ভালোসেন বা বেসেছিলেন?’

‘জি। কিন্তু যাকে ভালোবাসতাম সে হয়তো জানতো না আমার কথা। জানবেও না আর কোনোদিন।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url