ভৌতিক রহস্য গল্প : আঁমরা গোঁ নঁয়ন বাঁবু...
নাসির আহমেদ কাবুল
হঠাৎ কেন জানি ভূত দেখার ভূত চাপল আমার মাথায়। কিন্তু কীভাবে ভূত দেখব বুঝতে পারলাম না। ভূত কোথায় দেখা যায়, সে ব্যাপারে আমার কোনো আইডিয়া ছিল না। একদিন অফিসে কয়েকজন সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনারা কি কেউ কখনও ভূত দেখেছেন?
সবাই বলল, না। তারা কেউই ভূত দেখেনি। কেউ কেউ বলল, তারা ভূত বিশ্বাস করে না। যারা ভূত বিশ্বাস করে না, তাদেরকে বললাম, আপনারা কি অমাবষ্যার রাতে একা একা শ্মশানে গিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন? তারা জিজ্ঞেস করল, শ্মশানে কি ভূত থাকে? আমি বললাম, জানি না। তবে লোকজন সে রকমই তো বলে। তারা কিন্তু শ্মশানে যেতে রাজি হয়নি। কিন্তু আমাদের অফিস সহকারি নয়ন মিস্ত্রি চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ‘স্যার আমি ভূত দেখেছি। আমাদের অফিসেই ভূত আছে।’
নয়ন ভূত দেখেছেÑএ কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো নয়ন মিথ্যে বলেনি। নয়ন বয়স্ক মানুষ। আর কয়েক বছর পরেই তাকে অবসরে যেতে হবে। এই বয়সে অর্থাৎ যথেষ্ট পরিণত বয়সে কেউ মিথ্যা বলে না।
কেউ কেউ যে নয়নের কথা বিশ্বাস করতে পারেনি, সে কথা নয়ন বুঝতে পেরে বলল, স্যার আপনারা হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেননি। বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যে কিছু বলছি না। আপনারা তো জানেন আমাদের এই অফিস বিল্ডিংটার একটা ইতিহাস আছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সৈন্যরা এখানে টর্চার সেল বানিয়েছিল। পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকাররা মুক্তিবাহিনী ও স্বাধীনতা-পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে এই বিল্ডিংয়ের টর্চার সেলে নির্যাতন করত। নির্যাতন শেষে তাদের হত্যা করে বিল্ডিংয়ের সামনে মাটিতে পুঁতে রাখত। স্বাধীনতার পর এই বিল্ডিংটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। কেউ ভয়ে এখানে আসত না।
নয়ন আমাদের অফিসের খুব পুরোনো কর্মচারি। তার বয়স ষাট ছুঁই-ছুঁই করছে। এশাত্তর সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেছে সে, দেখেছে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারদের নির্মম নির্যাতন।
নয়নের কথা অনেকে বিশ্বাস না করলেও তার ভূত দেখার বিষয়টি শুনতে আগ্রহী হলো সকলেই।
নয়ন কীভাবে ভূত দেখেছে, ঘটনাটি খুলে বলতে বললে নয়ন বলল, স্যার সে তো অনেক কথা। আপনারা এখন কাজ করছেন। রাতের শিফটের নিউজের কাজ বেশি থাকে। এ সময় ভূতের কথা শুনতে গেলে আপনাদের কাজের তো ক্ষতি হবে।
আমরা স্বীকার করলাম যে কাজের সময় ভূতের গল্প শোনা যায় না। এতে কাজে ভুল হতে পারে।
আমাদের এই অফিসটি একটি নিউজ এজেন্সি। অর্থাৎ আমাদের কাছ থেকে পত্রিকাওয়ালারা নিউজ নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশ করে। সে জন্য আমাদের প্রত্যেকের খুব দায়িত্বশীল হতে হয়। আমরা বললাম, তাহলে আজ আর দরকার নেই। যেদিন কাজের চাপ কম থাকবে, সেদিন নয়নের কাছ থেকে ভূতের গল্প শোনা যাবে।
সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল। খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেলাম। আমি বাসায় একাই থাকি। তাই রাতে একা একা ঘুম আসছিল না। কেবলই মনে হতে লাগল যে, সত্যিই সত্যিই ভূত আছে। না হলে নয়ন ভূত দেখবে কোত্থেকে? এতদিন আমি ভূত বলে কিছু আছে, বিশ্বাস করতাম না, সেই আমি এখন ভূতের ভয়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারছি না! চোখ বুজলেই মনে হতে থাকে, কেউ বুঝি এসে আমাকে গলা টিপে ধরবে। সারারাত ঘরে আলো জ্বেলে বিছানায় চুপটি করে রাতটা কাটিয়ে দিয়ে সকাল হলে বেশ খানিকটা সময় ঘুমাতে পেরেছিলাম।
দুপুরের খাওয়া শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও গেলাম না। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সন্ধ্যা হবে, কখন অফিসে গিয়ে নয়নের সঙ্গে দেখা হবে। কখন জানতে পারব নয়ন কীভাবে ভূত দেখেছিল।
সন্ধ্যা হতেই অফিসে গিয়ে হাজির হলাম, যদিও আমার ডিউটি শুরু রাত আটটা থেকে। রাত আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আমাকে অফিসে একটানা কাজ করতে হয়। মনে মনে ঠিক করলাম, আজ অফিসের কাজের সময় না পেলেও রাত বারোটার পর নয়নের ভূতের গল্প শুনব, যদি নয়নের আপত্তি না থাকে।
রাত বারোটার মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ হলো। সবাই চলে গেলেও একজন সহকর্মী আমার সঙ্গে থেকে গেল ভূতের গল্প শুনবে বলে। রাত বারোটার সময় চা-বিস্কুট খেয়ে কিছুটা তাজা হয়ে নয়নকে বললাম, নয়ন এবার তাহলে শুরু করো তোমার ভূতের গল্প।
ভূতের গল্প বলতে নয়ন অনেকটা আপত্তি করে বলল, স্যার এগুলোকে গল্প বলবেন না। আমি যেটা দেখেছি, সেটা বাস্তব, বানানো কোনো গল্প নয়। বাস্তবতাও যে গল্প হয়, সেটা নয়নের জানা বলেই তার এই আপত্তি।
নয়ন আরো বলল, স্যার অফিস রুমবন্ধ করে দিয়ে চলুন আমরা ছাদের গিয়ে বসি।
কেন জিজ্ঞেস করতেই বলল, অন্ধকারে ভূতের কথা জমে ভালো। কেমন গা শির শির করে। চলুন ছাদেই যাই।
নয়নের কথা শুনলাম। তার সঙ্গে ছাদের গিয়ে বসলাম। আমাদের অফিসের ছাদে বসার জন্য ব্যবস্থা আছে। বিকেলে বা সন্ধ্যায় অনেকে এখানে এসে আড্ডা দেয়।
আমাদের ছাদের পাশেই বিশাল একটি আম গাছ। গাছটিতে আমি কখনও আম হতে দেখিনি। তবুও ওর পরিচয় আম গাছ। শুনেছি এই গাছটির বয়স প্রায় সত্তর-আশি বছর। অনেক কিছু সাক্ষী এই গাছটি। নয়নই সে কথা বলেছে আমাদের।
নয়ন বলল, প্রথমে সে নাইটগার্ড হিসেবে এই অফিসে জয়েন করে। কাজ শেষে সবাই বাড়ি চলে গেলে নয়ন ভোর পর্যন্ত অফিসে পাহাড়াদারের কাজ করত। নয়ন এই অফিসে যখন নাইটগার্ডের চাকরি করে, তখন থেকে ভূতের সঙ্গে তার দেখা হয়। এখনও নাকি সেই ভূতগুলোই নয়নের সঙ্গে কথা বলে! আমার কাছে নয়নের কথাগুলো খুব অদ্ভুত মনে হয়েছে। ভূতের সঙ্গে মানুষের কথা বলা সত্যিই অদ্ভুত রোমাঞ্চকর একটি বিষয় বটে।
এখন নয়নের মুখ থেকেই শোনা যাক তার ভূতের সত্যি সত্যিই গল্প।
নয়ন বলতে শুরু করলো, স্বাধীনতার বেশ কিছু বছর পর যখন এই বাড়িটিতে অফিসের কাজ শুরু হয়, তখন থেকে আমি এই অফিসে কাজ করছি। প্রথমে নাইটগার্ড। তারপর বর্তমানে আমি অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত আছি। সে সময় আমাকে বেশি বেতন দিয়ে নাইট গার্ডের চাকরি দেয়া হয় এই অফিসে। কারণ এই বিল্ডিংয়ে পাকিস্তানীরা মানুষ হত্যা করেছে এবং এখানে কবর দিয়েছে শুনে অনেকেই নাইটগার্ডের চাকরিটি করতে চাইত না। কিন্তু আমার কোনো ভয় ছিল না। কারণ ছোটবেলায় একজন তান্ত্রিকের সঙ্গে আমি শ্মশানে রাত কাটিয়েছি। তান্ত্রিক আমার মামা হওয়ায় আমাকে তন্ত্রমন্ত্রে দীক্ষা দিতে চাইতেন। আমিও আগ্রহী হয়ে তার সঙ্গে শ্মশানে যেতাম।
আমি বললাম, নয়ন তুমি যখন শ্মশানে রাত কাটিয়েছ তখন কি কোনো ভূত দেখেছ?
নয়ন বলল, স্যার শ্মশানের ভূতের গল্প বলতে গেলে তো রাত ভোর হয়ে যাবে। শ্মশানের ভূতের কথা না হয় আরেকদিন শুনবেন, আজ আমাদের এই অফিসের ভূতের কথা বলছি শোনেন।
আমি ও আমার আরেক সহকর্মী নড়েচড়ে গায়ে গা লাগিয়ে বসলাম। ভূতের গল্প শোনার আগেই আমরা ভূতফোবিয়ায় আক্রান্ত হলাম। আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। অন্ধকারে নয়ন সেটা লক্ষ করেনি, করলে হয়তো সে ভূতের গল্প বলতে চাইতো না।
নয়ন বলল, প্রথম প্রথম নাইট ডিউটি করতে এসে ভালোই লাগত। হাতে বাঁশের লাঠি আর বাঁশি ছিল। রাতে মাঝে-মধ্যে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে হাঁক দিতাম, ‘কে-রে ওখানে-সাবধান! সাবধান!’ এ কথা কাউকে না দেখেই বললতাম।
হঠাৎ একদিন মনে হলো আমাদের ছাদের উপর কারা যেন চলাফেরা করছে। তাদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। চিলেকোঠার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে আমি বাঁশিতে জোরে ফুঁ দিতে দিয়ে গলা ছেড়ে হাঁক দিলাম-‘কে রে ওখানে! সাবধান! সাবধান!’ বিশ্বাস করুন স্যার, বেশ কয়েকজন হিহি করে হাসতে হাসতে নাকি গলায় বলল, আঁমরা গোঁ নঁয়ন বাঁবু!
আমি ছাদের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। অথচ খুব কাছে ওদের কণ্ঠ শুনে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল দৌড়ে পালাই, কিন্তু পায়ে জোর পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম আমি।
তারপর? ফ্যাঁসফেঁসে গলায় জিজ্ঞেস করল আমার সহকর্মী। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। খুব ঘামছিলাম। নয়নকে গল্পটি থামাতে বলব, তাও পারছিলাম না। পাছে সে আমাকে ভীতু মনে করে।
নয়ন বলতে লাগল, এক সময় আমি বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলাম। আবার যখন হুঁশ ফিরে পেলাম তখন দেখলাম, প্রায় পাঁচ-ছয়জন সাদা আলখেল্লা পরে হাত ধরাধরি করে নাচছে আর বিদঘুটে ভাষায় কীসব গান গাচ্ছিল।
নয়ন যখন এসব ভূতের কথা বলছিল, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় একটা। চারদিক নিস্তব্ধ-নিঝুম। হঠাৎ পারফিউমের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগল। আমি টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সহকর্মী নয়নকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের কাছাকাছি কি পারফিউমের কোনো কারখানা আছে?
হঠাৎ নয়ন টর্চের আলো এদিক-সেদিক ফেলতে ফেলতে বলল, স্যার আপনারা একটুও ভয় পাবেন না। ওরা আসছে! নয়ন তারপর চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘সাবধান! সাবধান! একদম চুপ! স্যাররা আছেন, একদম কেউ সামনে আসবি না!’
হঠাৎ আমার সহকর্মী অজ্ঞান হয়ে চেয়ারসহ মাটিতে পড়ে গেল। আমার অবস্থাও সহকর্মীর মতো। তবুও নয়ন ও আমি তাকে ধরাধরি করে অফিস রুমে নিয়ে এলাম। তার যখন জ্ঞান ফিরে এলো, তখন মসজিদে ফজরের আজান শুরু হয়ে গেছে। নয়ন বলল, এখন আর ভয় নেই স্যার। ফজরের আজান শুনলে ওরা আর কেউ থাকে না।
শেষ