অপারেশন রেসকিউ [২]

 দুই


মানু মাসীকে কথা দেয়ার পর আরও কয়েক বছর কেটে গেলো অথচ মানু মাসীকে আর দেখতে যাওয়া হয়নি। এর মধ্যে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। গ্রাম ছেড়ে শহরের নতুন পরিবেশে দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিলো আমার। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেলো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকা ও দেশের বড়-বড় কয়েকটি শহরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করলো। ঘুমন্ত মানুষের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করলো ওরা। 

হাজার-হাজার মানুষ প্রাণের ভয়ে ঢাকা শহর থেকে পালাতে লাগলো। পথে-পথে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট এবং ক্ষুধায় ক্লান্ত শিশু ও বয়স্ক মানুষ পায়ে হেঁটে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করলো। 

আমাদের বাড়িতে রেডিও নেই। তাই বন্দরে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে দেশের খবরাখবর জানার জন্যে মনটা অস্থির হয়ে উঠলো। তাছাড়া অবিনাশের দোকানে সন্ধ্যার আড্ডাটাও মাটি হতে দেয়া যায় না। এদিকে সকাল থেকেই ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে। সারাদিনে একবারও ঘর থেকে বের হতে পারিনি। কী করা যায়—ভাবতে ভাবতে অনেক খোঁজাখুঁজির পর পুরানো একটি ছাতা পাওয়া গেলো। ধূলো-বালিতে ছেয়ে আছে ছাতাটি। তাও যদি অক্ষত থাকতো! ছাতার ডাঁট ভাঙ্গা, কাপড় ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। তবুও এটি এখন আমার কাছে যক্ষের ধনের মতো মনে হলো।

খুব যতœ করলাম ছাতাটিকে। ছেঁড়া গেঞ্জি দিয়ে মুছলাম। ডাঁটটাকে সুতলি দিয়ে বেঁধে কোনরকম চলনসই করলাম। এবার আমায় কে আর পায়! বেরিয়ে পড়লাম অবিনাশের দোকানকে উদ্দেশ্য করে।

অবিনাশরা কর্মকার। বন্দরে আরও কয়েক ঘর কর্মকার আছে। তারা লোহা দিয়ে দা, বটি, খুন্তা ইত্যাদি তৈরি করে। অবিনাশ এটা মানতে চায় না। নিজেকে তাই স্বর্ণকার বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। 

মাঝে-মধ্যে আমাদের আড্ডার মাঝখানে অবিনাশকে কর্মকার বলে ক্ষেপিয়ে দেয় নূরু। নূরুর সঙ্গে যেন ওর সাপে-নেউলে সম্পর্ক। অথচ একজন একজনকে একবেলা না দেখলে থাকতেই পারে না।

ঘর থেকে বের হয়ে ভাঙা ছাতা নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে যখন অবিনাশ, পরিমল ও নূরুকে নিয়ে ভাবছিলাম, হঠাৎ তখন দমকা বাতাসে ছাতাটি গেলো উড়ে। মেঠো পথের দু-ধারে ধানক্ষেত বৃষ্টির পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। ছাতাটি উড়ে গিয়ে পড়লো ধানক্ষেতের মধ্যখানে। হঠাৎ কোথাও এক কিশোর খিল খিল করে হেসে উঠলো। তাকিয়ে দেখলাম ছাতাটি ভেসে ভেসে ক্রমাগত দূরে চলে যাচ্ছে। এসব দেখে এক কিশোরের হাসি যেন থামতেই চাইছে না! বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি, সেদিকে খেয়াল নেই আমার। একবার ছাতার দিকে তাকাচ্ছি আবার কোথায় কে হাসছে দেখার জন্য তীক্ষè দৃষ্টি ফেলছি। না কোথাও কেউ নেই।

ছাতাটি রইলো পড়ে। বৃষ্টির মধ্যেই হেঁটে চললাম আমি।

ছাতাটি নেবেন না?

হঠাৎ এক কিশোরের কণ্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম রাস্তার পাশে একটি ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে গুটিসুঁটি মেরে একটি ছেলে বসে আছে। ওর দুই চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।

দাঁড়ালাম।

বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য একটি কলাপাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে এলো ছেলেটি। ওর হাতের কলাপাতাটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, নিন। ভিইজ্যা যাইতাছেন তো! এইডা মাথায় দেন।

কলাপাতাটি নিলে ছেলেটি যে ভিজে যাবে! তাই ইতস্তত করলাম। হাত বাড়িয়েও আবার গুটিয়ে নিলাম।

কি নেবেন না?।

ছেলেটি আমাকে তাড়া দিলো।

ভিজে যাবে তো তুমি? অপরাধীর মতো বললাম।

আবার হাসলো ছেলেটি। বৃষ্টি ও মেঘগর্জনের মধ্যে ওর হাসির শব্দ একাকার হয়ে গেলো। অসম্ভব রকম একটি ভালোলাগা আচ্ছন্ন করলো আমাকে।

ছেলেটি ওর কলাপাতাটি আমার মাথার উপর মেলে ধরলো। বললো, ভিজলে অসুখ হইবো আপনার। এই নেন—।

জোর করে আমার হাতে কলাপাতাটি ধরিয়ে দিয়ে ছাতাটিকে ধরার জন্যে ছেলেটি দৌড়ে ধানক্ষেতের মধ্যে চলে গেলো।

মাঠে এক হাঁটু পানি। তার মধ্যে ধানের চারাগুলো কোনরকম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি সেসব তোয়াক্কা না করে ছাতাটির পিছনে ছুটছে। কিন্তু না, কিছুতেই ছাতাটি ধরতে পারছে না ছেলেটি। ও যতোই ছাতাটির কাছাকাছি যাচ্ছে, বাতাস ছাতাটিকে ততোটা দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ছেলেটিও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই হার মানতে চাইছে না। শেষতক সে ধরে ফেললো অবাধ্য ছাতাটিকে। 

ছাতাটি গুটিয়ে বগলদাবা করে দৌড়ে চলে এলো আমার কাছে। ওর মুখে তখন বিজয়ের হাসি। সাদা চকচকে একপাটি দাঁত ওর। গায়ের রঙ কালো। কালো রঙের মানুষের দাঁতগুলো সব সময়ই চকচকে হয়। এ কারণে কালো মানুষের হাসি খুব সুন্দর। 

ছাতাটি আমার হাতে দিয়ে বললো, আহারে এক্কেবারে ভিইজ্যা গেছেন! এই নেন আপনার ছাতা। এবার আর ভিজতে হইবো না আপনাকে।

বললাম, আমি আর কতোটুকু ভিজেছি, তুমি তো পুরোটাই ভিজে গেছো। এমন করে ভিজলে তোমার জ্বরটর হয়ে যাবে।

আমার কথা শুনে হাসলো ছেলেটি। বললো, জ্বর হইবো কেন? রোজই তো ভিজি। আপনার জ্বরটর হইতে পারে। আপনার যে অভ্যাস নাই।

তোমার অভ্যাস আছে বুঝি?

আছে না! আমি রোজই ভিজি। বৃষ্টি হইলেই ভিজি। মা কতো বকে। মারেও। হের পরও ভিজি। কী করমু কন তো, বৃষ্টি শুরু অইলে যে ঘরে থাকতে মন চায় না। 

বৃষ্টি তোমার বুঝি পছন্দ?

খুউব—।

কেন?

Ñক্যান, কী জানি! ভিজতে ভালো লাগে। ওই যে আমার ঘর দেখতাছেন না! ওইটা বানাইছি আমি। বৃষ্টিতে ভিইজ্যা যখন শীত লাগে, তহন ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াই। যখন মেঘেরা শব্দ করে, তখনও ওই ঘরের মইধ্যে যাই। 

বজ্রপাতের শব্দে তোমার ভয় করে না?

ঠাডা পড়ার কথা কইছেন? হ, ভয় করে তো!

তাহলে?

কী করবো? একা যে!

তোমার কেউ নেই বুঝি?

আছে। মা।

বাবা নেই?

কী জানি কী ভাবলো ছেলেটি। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই ওর মুখে অন্ধকার নেমে এলো। এই প্রথম হাসি ভুলে গেলো ছেলেটি। বললো, বাবা থাকলে কী আর মাকে এতো কষ্ট করতে হয়?

কী করেন তোমার মা?

মাইনষের বাড়িতে কাম করে। হেই সকাল থিক্কা রাইত পর্যন্ত।

বাবা কি মারা গেছেন?

বাবার মারা যাবার কথা শুনে আঁৎকে উঠলো ছেলেটি। বললো, না-না, মরবে কেন? বাঁইচ্চা আছে। তয় আমাগো জিগায় না। খবরও নেয় না।

কোথায় থাকে তোমার বাবা?

জানি না। হুনছি শহরে, রিকশা চালায়।

বললাম, তোমার তো নাম জানা হলো না। কী নাম তোমার?

দাঁত বের করে হাসলো ছেলেটি। বললো, আমার নাম দিয়া কী করবেন? সবাই আমারে পিচ্চি কইয়া ডাকে। শুধু মায়ে আমার নাম ধইর‌্যা ডাকে।

তোমার মা তোমাকে কী বলে ডাকে?

হাসবেন নাতো?

হাসবো কেন?

মায়ে আমারে কতো নামে ডাহে! আলু, পটল, বলটু, পল্টু আরো কতো কী, হে কথা আর আপনেরে কী কমু? তয় মায়ে আমারে পটল নামেই বেশি ডাহে। মায়ে কয় পটলচেরা চোখ আমার। আইচ্ছা হেইডা আবার কি? মায়েরে জিগাইছিলাম, কী যে কইলো বুঝতে পারি নাই।

তার মানে তোমার চোখ দুটি বেশ সুন্দর।

হাচা কইতাছেন?

সত্যিই বলছি, তোমার এই পটল নামটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার।

কন কী, পটল নামটা পছন্দ আপনার? আমার কিন্তু আরেকটা নাম আছে। হেইডা আমার ভালো নাম। বাজান দিছিলো। দাদায় আমারে হেই নামেই ডাকতো। দাদা মারা যাওনের পর হেই নামে আর কেউ ডাকে না।

তোমার ভালো নামটা কী?

মোহাম্মদ মাহফুজ মিয়া।

তাহলে তোমাকে মাহফুজ বলে ডাকবো?

না, না। খালি মাহফুজ কইয়া ডাকলে পাপ হইবো। মোহাম্মদ কইতে হইবো। মুসলমানের নামের আগে নবী-রসূলের নাম কি বাদ দেওন যায়? 

না, যায় না।

তয়?

তবে কী?

পটল কইয়া ডাকবেন। অত বড়ো নাম ডাকনের দরকার নাই।

আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে পটল বলেই ডাকবো তাহলে।

পটল খুশি হলো কিনা বোঝা গেলো না। মাথা চুলকিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো। কী একটা বলতে চাচ্ছে ও। বললাম, কিছু বলবে?

কইছিলাম...।

কী বলো। দ্বিধা করছো কেন?

কইছিলাম, আপনি তো শহরে থাকেন?

হ্যাঁ, থাকি তো।

Ñআমার বাবারে যদি দেহেন আমার কথা কইবেন। কইবেন, আমি হের লাইগ্যা অপেক্ষা কইরা আছি। কতো লোকের বাবা আছে। আমার বাবা থাকতেও নাই। হেরে হেই কথাডা বুজাইয়া কইবেন।

কিন্তু তোমার বাবাকে চিনবো কেমন করে?

কী কন চিনবেন না! হের নাম মোহাম্মদ রমিজ মিয়া। গ্রামের লোকে হেরে লম্বা রমিজ কইয়া ডাকে। শহরে গিয়া খালি কইবেন লম্বা রমিজ মিয়া কেডা? দেখবেন সক্কলে আমার বাপেরে দেহাইয়া দিবো।

পটলের কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, আচ্ছাÑআচ্ছ, ঠিক আছে।

বুঝলাম পটল খুব খুশি হয়েছে। পটল হয়তো এর আগে কখনও শহর দেখেনি। দেখলে এমনভাবে বলতে পারতো না। ও জানে গ্রামের লোকজন যেহেতু লম্বা রমিজ বললেই ওর বাপকে চেনে, শহরের লোকজনও তেমনি চিনবে। কিন্তু শহরে যে হাজারও লম্বা রমিজ আছে। কে কার খোঁজ রাখে—এই সত্যিটা ওকে বলতে পারলাম না। 

পটল বললো, আপনি বুঝি বাজারে যাইতাছেন? কিছু আনবেন বুঝি? 

বললাম, না না তেমন কিছু না।

Ñকিছু আনতে হইলে আমারে কইয়েন। আমি মাথায় কইরা আপনাগো বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিমু।

ওকে বাধা দিয়ে বললাম, না-না তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। যদি কিছু আনি, আমি নিজেই পারবো।

পটল বললো, কী যে কন, কষ্ট আবার কি! আপনার একটা কাম কইরা দিমু, হেতে আবার কষ্ট হইবে কি? 

তুমি বুঝি অনেক কাজ করো?

করি না আবার! কত কাম করি। এই যেমন বাগান থেইক্যা ঢেঁকির শাক তুইল্যা আনি, পুকুর থেইক্যা শাপলা। জানেন, বড়শি দিয়া মাছও ধরতে পারি। 

বললাম, ঠিক আছে, কিছু যদি আনি, তোমাকে বলবো।

আচ্ছা। আমারে এহানেই পাইবেন। যদি দেখতে না পান তাহলে পটল কইয়া একটা ডাক দেবেন। ওই যে, দেহেন ছনের একটা ঘর, ওই যে, নারকেল গাছ—ওইহানে আমি আর আমার মায়ে থাহি। আচ্ছা ঠিক আছে, আপনাকে একদিন আমাগো বাড়িতে লইয়া যামুনে। 

বললাম, আচ্ছা, একদিন যাবো তোমাদের বাড়ি।

বুঝলাম পটল খুব খুশি হয়েছে। বললাম, তাহলে এখন যাই।

ঠিক আছে যান। 

আমার আর কোন কথা শোনার অপেক্ষা করলো না পটল। হেঁটে ওর খেলাঘরের দিকে চলে গেলো। আমি চেয়ে-চেয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। 


চলবে

https://protilipi24.blogspot.com/2024/08/blog-post_20.html




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url