চা শিল্পে নারী শ্রমিকরা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার
নাসির আহমেদ কাবুল
গলায় মাদুলি, কানে ঝুমকা ও নাকফুলের রূপার অলংকারে সজ্জিত শোভা রানীর বয়স পঞ্চাশ। তার পরনে হাতেবোনা লাল-নীল দোপাট্টা। পিছনে চা পাতা রাখার বাঁশের ঝাঁপি। বয়সের কারণে কিছুটা বেঁকে গেছেন তিনি। তবে এই বয়সেও তিনি চা বাগানে হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে একটুও ক্লান্তিবোধ করেন না। তবে হতাশা রয়েছে তার অনেক। দীর্ঘ জীবনের বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন স্বল্প মজুরির কথা। কখনও কখনও অর্ধাহারে-অনাহারে জীবনযাপনের কথা।
ইংরেজ শাসন আমলে সেই ১৮৫৪ সালে সর্বপ্রথম সিলেট অঞ্চলে চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় ব্রিটিশ কোম্পানীগুলো বিহার, উরিষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে সিলেট অঞ্চলের চা বাগানে চা পাতা সংগ্রহ ও পাতা চয়নের কাজ দেয়। সেই থেকে বংশপরম্পরায় তারা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে দেশের অর্থনীতিতে জোরালো ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে চা অন্যতম। পৃথিবীর দশটি চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। চা বোর্ডের সূত্র মতে, দেশের ছোট-বড় ১৬৪টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩টি। হবিগঞ্জে ২২টি, সিলেটে ২০টি, চট্টগ্রামে ২২টি, রাঙ্গামাটিতে ১টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি চা বাগান রয়েছে। পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকায় আরো ৫টি চা বাগান প্রতিষ্ঠা হয়েছে। মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩টি বাগানের মধ্যে ১৯টি রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। এসব চা বাগানের ৪৪টি ফাঁড়ি বাগান রয়েছে। দেশের ১৬৪টি মূল বাগান এবং ৪৪টি ফাঁড়ি বাগান মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা ৭ লক্ষাধিক।
সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) থেকে প্রকাশিত চা শ্রমিকের কথা বইটিতে ডা. নিবাস চন্দ্র পাল উল্লেখ করেছেন, চা বাগানের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ নারীই রক্ত শূন্যতার মাঝে গর্ভধারণ করেন। অপুষ্টি ও বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ। চা বাগানে মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৪। ঘন ঘন গর্ভধারণ, অবাঞ্ছিত গর্ভপাত, পরবর্তী সেবার স্বল্পতা ও পরিবার পরিকল্পনার অভাব ইত্যাদি রক্ত শূন্যতার জন্য দায়ী। তিনি আরো বলেন, চা বাগানে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিটি চা বাগানেই রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর অভাব। অধিকাংশ শিশুরই জন্ম হয় মাটির মেঝে, চটের ছালায় বা পলিথিনের ওপর। নারী চা শ্রমিকরা ম্যালেরিয়া, কৃমি, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, গনোরিয়া, সিফিলিস, স্ক্যাবিস, চর্মরোগ প্রভৃতি রোগে ভোগেন।
চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত এসব শ্রমিকের নেই কোনো নিজস্ব বাসস্থান। যুগ যুগ ধরে বাগানের তৈরি মাটির ঘরে বসবাস করে চললেও তাদের আবাসন সমস্যা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই বাগান কর্তৃপক্ষের। তাদের নিজস্ব সম্পদ বলতে ছেঁড়া চট, টিনের মগ, থালাবাটি। চা বাগানের অভ্যন্তরের রাস্তার ২ পাশে ছনের ছালা আর মাটি দিয়ে তৈরি মাত্র ৮ হাত প্রস্থ আর ১২ হাত দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একেকটি ঘর তাদের ৩ পুরুষের স্থায়ী ঠিকানা। এক সঙ্গে বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পরিবার-পরিজন নিয়ে ওই একমাত্র ঘরেই চলে তাদের জীবন সংসার। প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাদের ঘরের দৈর্ঘ্য। এ সমস্যা প্রতিটি বাগানে। আলো-বাতাসহীন ঝুপড়ি ঘর আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিকদের রোগব্যাধি নিত্যসঙ্গী।
স্যানিটেশন বলতে কিছুই নেই চা বাগানে। চা গাছের নিচে, ডোবা আর ঝোপঝাড়ে চলে প্রাকৃতিক কার্য সম্পাদনের কাজ। এতে বাড়ছে রোগব্যাধি।
চা শ্রমিকরা জানান, শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মজুরি প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গেও উৎপাদনশীলতার প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশে একজন শ্রমিক দৈনিক গড়ে ২৫-৩০ কেজি পাতা তুলতে পারেন। কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা উন্নত হলে ৫০-৫৫ কেজি বা তার অধিক পাতা তোলাও সম্ভব।
চা শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ বাগানেই কোন সরকারি প্রাথমিক প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। ফাঁড়ি বাগান মিলিয়ে মোট ২৪০টি চা বাগানে সরকারি ও স্যাটেলাইট বাগানে রয়েছে মাত্র ৯টি বিদ্যালয়। গত দেড় বছরে অন্যান্য চা বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকাওয়াস্তে করা হলেও সেখানে নেই ছাত্র এবং শিক্ষকদের বসার কোন আসবাব। নেই শিক্ষা উপকরন। ব্রেঞ্চ-ডেস্ক না থাকায় অধিকাংশ বিদ্যালয়ে মাটিতে চট বিছিয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান দিন দিন এগিয়ে গেলেও চা বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
ইউনিসেফ ফিচার
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)