ফিরে এসো নীলাঞ্জনা [৫]
পাঁচ
অনিমেষ কথা দিয়েছিল অমিতের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। তার সে ক্ষমতাও আছে। সে একটি দৈনিকের নিউজ এডিটর। পত্রিকার মালিক-সম্পাদক অনিমেষের ওপর ভরসা রাখেন, বিশ্বাস করেন। তার কারণেই পত্রিকার কাটতি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে পত্রিকাটির সার্কুলেশন দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিমেষ ব্যানার্জী অমিতের সিনিয়র ছিল। অমিত তার সঙ্গে এবং পাশের রুমে একই হলে থেকেছে। অমিতকে সে ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিল। তারই অনুরোধে ডাকসু নির্বাচনে হল শাখা থেকে সাহিত্য সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিকে হারিয়ে দিয়েছিল অমিত। চাকরির জন্য অমিত যে কজনকে বলে রেখেছে তার মধ্যে অনিমেষ ব্যানার্জী অন্যতম। অনিমেষ কথা দিয়েছিল সুযোগ হলেই অমিতকে ডেকে নেবে।
কিছুক্ষণ আগে অনিমেষ ব্যানার্জী ফোন করেছিল অমিতকে। আগামীকাল সকাল দশটায় তার কাছে যেতে বলেছে। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক আতিয়ার রহমান সাহেবের সঙ্গে কাল দশটায় এপয়েনমেন্টও করে রেখেছে। কিন্তু অমিত গত কয়েকদিন ধরে খুব অসুস্থ। জ্বর ও শরীর ব্যথা তার। অমিতের শরীর খুব খারাপ থাকায় গত দুদিন রউফ সাহেব অফিসে যায়নি। আজ কিছুটা সুস্থ হলে চাকরির ব্যাপারে বাইরে যেতে হবে শুনে রউফ বলল, ‘তা কী করে সম্ভব?’ অমিত বলল, ‘যেতেই হবে।’ রউফ সাহেব অমিতকে সঙ্গে নিয়ে আজ আগামী পত্রিকা অফিসে গেল। অমিত গিয়ে দেখে তার আগেই অনিমেষ ব্যানার্জী টেবিলে বসে আছে। অমিত রউফ সাহেবকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ভদ্রলোক তার রুমমেট। অসুস্থ বলে একা ছাড়লেন না, পৌঁছে দিতে এসেছেন। তারপর চা পানের পর রউফ সাহেবকে বসিয়ে রেখে অমিতকে নিয়ে অনিমেষ আতিয়ার রহমান সাহেবের রুমে গেল।
সম্পাদক সাহেবের বিশাল রুম। তার একপাশে সম্পাদকের টেবিল। পুরো রুম জুড়ে দুইসেট সোফা ছাড়াও অনেকগুলো চেয়ার রাখা আছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে জরুরি কোনো সভা সম্পাদকের রুমেই হয়। অনিমেষ অমিতকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘অমিত ও আমি একই হলে থেকেছি। ও যখন ভর্তি হয় তখন আমি মাস্টার্স করছিলাম। ডাকসু নির্বাচনে অমিত হলে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল।’
বেশ রাশভারী আতিয়ার সাহেব। কথা কম বলেন। তবে যেটুকু বলেন খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই বলেন। অমিতের পছন্দ হলো সম্পাদক সাহেবকে। চায়ের অর্ডার দিয়ে দুচারটি কথা বললেন তিনি অনিমেষের সঙ্গে। তারপর অমিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি সাংবাদিকতার মতো একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা কেন বেছে নিলে? এই লাইনে সমস্যার অন্ত নেই, সেটা জানো নিশ্চয়ই?’
অমিত ধীরেসুস্থে বলল, ‘জানি স্যার। এই পেশা চ্যালেঞ্জিং জেনেও নিজেকে তুলে ধরতে পারব বলে মনে করছি।’
অমিতের কথায় সম্পাদক সাহেব খুশি হলেন কি না বুঝা গেল না। তিনি বললেন, ‘বাংলাটা কেমন জানো তুমি?’
‘খুব বেশি না স্যার। তবে যতটুকু জানি আশা করি পারব।’
‘কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়েছ?’
‘বাংলা সাহিত্য।’
‘ওকে। আত্মবিশ্বাস থাকাটা ভালো। তবে স্যার বলে সম্বোধন করার দরকার নেই। ভাই বলেই ডেকো। এই লাইনে সবাই সবার ভাই।’
অমিত মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল।
আতিয়ার সাহেব বললেন, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীগুলোতে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছেÑএই লইনটি কি ঠিক আছে? না থাকলে শুদ্ধ রূপটা কী হবে তুমি বলতে পারবে?’
অমিত বলল, ‘লাইনটায় ডাবল প্লুরাল ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য এটি ভুল বাক্য। এটার শুদ্ধ রূপ হবে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।’
সম্পাদক সাহেব হাসলেন। এরপর বললেন, ‘সকাল এগারোটায় কথা হবে।’ লাইনটি কি ঠিক আছে?
অমিত বলল, ‘না ঠিক নেই।’
‘তাহলে?’
‘বেলা এগারোটা হবে। সকাল ১০টা ৫৯ মিনিট হতে পারে, তবে বেলা এগারোটা বলাই সমীচীন।’
সম্পাদক সাহেব বললেন, ‘খবরের ইনট্রো কী তুমি বলতে পারবে?’
‘জি। খবরের শুরুতে যে কয়েকটি লাইনে পুরো নিউজটির বিষয় তুলে ধরা হয়, তাকেই ইনট্রো বলে।’
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, যারা অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।- ইন্ট্রো হিসেবে এটা কতটুকু ঠিক?’
ঠিক আছে বলা যায়। তবে ইনট্রোতে কে বলেছেন সেটা মুখ্য বিষয় নয়, কী বলেছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেই মেসেজটা পাঠককে আগে দিতে হবে। যেমন যারা অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে আজ মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখানে পাঠকের কাছে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন, সেটা।
সম্পাদক সাহেব বললেন, ‘তোমার নিউজের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। বার্তা সম্পাদক বা অন্য কাউকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যাবে না। কারণ বার্তা সম্পাদক খুুব ব্যস্ত থাকেন খবরের গুরুত্বÑবাছাই, হেডিং ও পৃষ্ঠা মেকআপ নিয়ে। তার সময়টা কিন্তু খুবই সংক্ষিপ্ত। এ জন্য তোমার নিউজটির সবটা হয়তো তার পক্ষে পড়া সম্ভব নাও হতে পারে। তিনি ইনট্রো পড়েই হয়তো হেডিং করে ছেড়ে দিলেন। রিপোর্টারের প্রতি বার্তা সম্পাদককে আস্থা রেখেই এমনটা করতে হয়। রিপোর্টে কোনোরকম ভুল থাকলে রিপোর্টারকেই দায়ী করা হয়। তুমি কথাটা বুঝতে পেরেছ?’
অমিত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, ‘বুঝতে পারছি। যদি আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে অত্যন্ত গুরুত্ব ও সতর্কতার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করব।’
অমিত সম্পাদকের রুম থেকে বের হয়ে নিউজ রুমে গিয়ে বার্তা সম্পাদকের টেবিলে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট দশেক পর অনিমেষ টেবিলে ফিরে এসে বলল, ‘তুমি তো একশতে একশ পেয়েছ অমিত! আমার মুখ উজ্জ্বল করেছ তুমি। কাল থেকে রিপোর্টিংয়ে জয়েন করবে। একটু পরে সিটি এডিটর আসবে। তিনি তোমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেবে। তার আগে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো।’
এই অফিসের পিয়নদের মধ্যে মাহবুব অন্যতম। তার এলাকায় সে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। একবার মাহবুবের লেখা কুকুরের উপর একটি নিউজ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এরপর সিটি করপোরেশেন থেকে বেশ কয়েকটি কুকুর মেরে নিয়ে যাওয়া হয় মাহবুবের কাছে। সিটি করপোরেশনের লোকেরা যে কুকুর মেরেছে তার সাক্ষীর জন্য প্রকাশিত নিউজের সাংবাদিক অর্থাৎ মাহবুবের সাক্ষর নেয় তারা। এরপর থেকে এলাকায় সে ‘সাংবাদিক মাহবুব’ নামে পরিচিতি পায়। এ কথা মাহবুব অফিসে জনে-জনে বলেছে। মাহবুব এসএসসি পাস, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেনি অভাবের কারণে। মাহবুবের বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলার অভ্যাস। একবার সিটি এডিটর সাহেব চা আনালে ক্রাইম রিপোর্টার চা পায়নি। কেন তাকে চা দেওয়া হলো না জিজ্ঞেস করলে মাহবুব বলেছিল, ‘টু টাকার টি এন্ড থ্রি জার্নালিস্ট! অতটুকু চা কতজনকে সার্ভ করব, টেল মি স্যার?’
মাহবুবের ওপর কেউ রাগ করে না। মাহবুবও সবার কথা অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলতে চেষ্টা করে। সেই মাহবুবকে একবার ফিচার এডিটর সাহেব থাপ্পর মেরেছিল বলে পুরো অফিস মাহবুবের পক্ষ নিয়েছিল। রহমান সাহেব বলেছিল ফিচার এডিটরকে মাহবুকের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে! এরপর থেকে রহমান সাহেব ফিচার এডিটরের চিরশত্রুতে পরিণত হয়েছিল।
সকাল সাড়ে এগারটার মধ্যে সিটি এডিটর সাহেব চলে এলো। অমিতকে পরিচয় করিয়ে দিলে সেদিনই সিটি এডিটর অমিতকে দু-দিনটা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট তৈরি করতে বলল। একটি ‘প্যাকেটজাত খাবারের নামে কী খাচ্ছি’ অন্যটি ‘সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি’। অমিতকে প্রাথমিকভাবে কিছুটা ধারণা দিয়ে দেওয়া হলো। সেদিনই কাজে লেগে গেল অমিত। আগামীকাল দুটি রিপোর্টই জমা দিতে পারবে বলে অমিত জানালে অবাক হলো সিটি এডিটর। বলল, ‘তুমি ভেবে বলছ তো?’
অমিত বলল, ‘আমি দিতে পারব।’
নিউজ এডিটর বলল, ‘সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে আজই তুমি এপয়েনমেন্ট লেটার পাচ্ছ। পেলেই তুমি জয়েনিং লেটার দিয়ে কাজে লেগে পড়ো।’
এরপর পড়ুন পর্ব ৬