তৃতীয় পক্ষ [পর্ব ২]
কয়েকদিন আগে মাস্টার্স পরীক্ষায় রেজাল্ট বের হয়েছে। সবাই আশা করেছিল সজল ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে। তা হয়নি। স্বাতী ফার্স্ট হয়েছে। এ নিয়ে সজলের নিজের কোন দুঃখবোধ নেই। কিন্তু স্বাতী মনক্ষুণœ। স্বাতী সজলের খুব ভালো বন্ধু। স্বাতী চেয়েছিল সজল ফার্স্ট হোক। তবে সজল মনে করে স্বাতীই ফার্স্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখে, ওরই ফার্স্ট হওয়া উচিত।
রেজাল্টের পর টিএসসি’র সবুজ চত্বরে বসে সজল হাসতে হাসতে স্বাতীকে বলল, ‘তাহলে আমাকে তুমি হারিয়ে দিলে?’
‘আমি তোমাকে হারাতে চাইনি সজল।’
‘কেন?’
‘আমি চেয়েছিলাম তুমিই ফার্স্ট হও। আর সেটাই তো হওয়া উচিত ছিল।’
‘উচিত কেন?’
‘দেখো সজল, তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশী ব্রিলিয়ান্ট। আমার মনে হয় তোমাকে কোথাও ঠকানো হয়েছে।’
‘ঠকানো হয়েছে! আমাকে ঠকাবে কে? কেনই বা ঠকাবে?’
‘তুমি পলিটিক্স কর। হয়তো কোন কোন স্যার তোমার এই পলিটিক্সটাকে মেনে নিতে পারেননি।’
‘তোমার ধারণা ঠিক নয় স্বাতী। সব স্যাররাই আমাকে ভালো জানেন।’
‘তাহলে মেয়ে বলে আমাকে হয়তো করুণা করা হয়েছে!’
‘সেটাও ঠিক নয়।’
‘তাহলে?’
‘তুমি ভালো লিখেছ, ভালো নম্বর পেয়েছ।’
স্বাতী কিছুক্ষণ চুপ থেকে সজলের চোখের দিকে তাকাল।
‘সজল বিশ্বাস কর, আমি চেয়েছিলাম, তুমি ফার্স্ট হও।’
‘আর আমি কী চেয়েছিলাম?’
‘কি?’
‘তুমিই ফার্স্ট হও।’
‘আমার ফার্স্ট হয়ে কীইবা হবে?’
হতাশ কন্ঠে বলল স্বাতী।
‘কেন আবার কী হল?’
‘বাবা আমার বিয়ে দেবেন বলে মনস্থির করেছেন।’
সজল কিছুক্ষণ স্বাতীর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘বিয়ে! তোমার?’
‘হ্যাঁ সজল।’
হঠাৎ সজল যেন জ্বলে উঠল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। চোখ দু’টি দিয়ে যেন আগুনের হলকা বের হতে লাগল। দাঁতে দাঁত পিয়ে সজল বলল, ‘না তা হতে পারে না।’
সজলের এই হঠাৎ পরিবর্তনে স্বাতী অবাক হল।
‘কী হতে পারে না, সজল?’
‘তোমার বিয়ে!’
‘কেন হতে পারে না?’
সজল কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকল। কয়েকটি ঘাস ছিড়ে মুখে নিয়ে দাঁত দিয়ে ছিড়ে আবার থু মেরে দূরে ফেলে দিল। এদিক-ওদিক তাকাল বেশ কয়েকবার। মুহূর্তের জন্যে একবার স্বাতীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
স্বাতী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল সজলকে। মনে মনে ভাবল, তাহলে কি বন্ধুত্বের সম্পর্কের বাইরেও সজল অন্য কিছু চিন্তা করছে তাকে নিয়ে? কই এতোদিনেও সজল তো তাকে এমন কিছু বলেনি। এমন কি ওর কথাবার্তায় বা আচার-আচরণে তেমন কিছুই ধরা পড়েনি!
সজল সিগারেট ধরাল। ধোঁয়ার কু-লি পাকিয়ে অদ্ভুত স্থির দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। মনে মনে ভাবল, কেমন অদ্ভূত মেয়ে স্বাতী! মেয়েরা নাকি ছেলেদের চোখ দেখে অনেক কিছু বুঝে নিতে পারে। কই স্বাতী তো কিছুই বুঝল না! নাকি বুঝেও না বোঝার ভাণ করছে!
‘এই সজল, তুমি তো কিছুই বলছ না?’
সজল স্বাতীর চোখে চোখ রাখল। স্থির থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিল। টোকা দিয়ে সিগারেটের টুকরোটা বেশ কিছুটা দূরে ফেলে দিল। এতটা দূরে গিয়ে পড়বে ভাবতেও পারেনি সজল। ঘাসের মধ্যে ডুবে গিয়েও সিগারেটের টুকরো থেকে ধোঁয়া বের হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল। সে দিকটায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে।
স্বাতী সজলের কাঁধে হাত রাখল।
‘তোমার কী হয়েছে সজল?’
‘কই কিছ্ ুনাতো!’
স্বাতী সজলের আরও কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। সজলের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও সজল?’
স্বাতীর স্পর্শে সজলের শরীরে যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হল। অন্যরকম এক ধরনের শিহরণ অনুভব করল সে। স্বাতীকে একটু ছুঁয়ে দেয়ার কতোদিনের ইচ্ছেটা আজ এমনিতে পূর্ণ হবে, ভাবতেও পারেনি সজল। অথচ কী একটা দ্বিধা তাকে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরেছে এতোদিন। বলি বলি করেও বলা হয়নি, ছুঁতে গিয়েও ছোঁয়া হয়ে ওঠেনি যাকে; আজ সে-ই তাকে ছুঁয়েছে কিছু একটা বলার জন্য বলছে! একি স্বপ্ন? নাকি সত্য! হোক না স্বপ্ন, তবু ভালো লাগছে সজলের। স্বাতীর হাতটাকে দুই হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরল সজল। একবার চোখ তুলে তাকাল সে স্বাতীর দিকে।
‘আমি তোমাকে...’
বাকীটা শেষ করতে পারল না কিছুতেই। হঠাৎ স্বাতীর হাতটা ছেড়ে দিল সে।
‘কী থামলে কেন?’
‘না, কিছু না।’
সজল না বললেও স্বাতীর বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি কী বলতে চায় সজল। স্বাতীর বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠল।
‘তুমি ভীতু সজল। এতটা ভীতু পুরুষ মানুষের জন্য বেমানান। সত্যিই বেমানান। তুমি খুলে বল, কী বলতে চাও। এই দেখো, আমার দিকে তাকাও। আমার এই ব্যাকুলতা একবার বোঝার চেষ্টা কর। তুমি যে কথাটি এতদিন ধরে গোপন রেখেছ, বলতে গিয়েও হোঁচট খেয়েছ বার বার, হয়ত সেই কথাটিই শোনার জন্য আমি জন্মজন্মান্তর অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। বল সজল, তোমাকে আজ বলতেই হবে।’
স্বাতীর কথা শুনে সজল চকিতে চঞ্চল হয়ে উঠল।
‘একি বলছ স্বাতী!’
‘কী আর বলব? তোমার এই ভীরুতার খেসারত আজ আমাদের দুজনকেই দিতে হবে।’ অনেকটা আপন মনে বলল স্বাতী। তারপর একটু থেমে বলল, ‘সত্যিই তুমি কি এতদিনেও কিছুই বুঝতে পারনি?’
না সজল, না। এতদিন আমি তোমার যে চোখ দেখেছি, সে তো কোন মানুষের চোখ নয়, পাথরের মূর্তির মত স্থবির, ভাষাহীন দু’টি চোখ। ওখানে আমি কামনা-বাসনা, ভালোলাগা-ভালোবাসার বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখতে পাইনি। তোমার মুখে রাজনীতির জটিল সমীকরণ শুনেছি। ওই চোখ, ওই মুখ যে ভালোবাসার কথাও বলতে পারে, আজ তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
‘কেন?’
‘কেন নয়? তুমি এখন বলতে পারছ না, তুমি আমাকে ভালোবাসো। আজ যখন দুজনের পথ দুদিকে বাঁক নিতে যাচ্ছে তখনও তুমি নির্জিব অলসতায় চমকে দিলে আমাকে!’
‘তুমি আমাকে ক্ষমা কর স্বাতী।’
‘আমি তোমার এই কাপুরষতাকে কোনদিনই ক্ষমা করব না সজল। আমি যদি তোমাকে না পাই, তাহলে শুনে রেখো, আমি বিষ খেয়ে মরবো।’
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে স্বাতীর গলা কেঁপে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা কান্না সামলে খুব কষ্টে কথাগুলো বলে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল স্বাতী। তারপর হন হন করে হেঁটে চলে গেল। সজল অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে ‘স্বাতী স্বাতী’ বলে ডাকল কয়েকবার। স্বাতী একবারও পিছন ফিরে তাকাল ন।
স্বাতী চলে যাবার পর সজল চত্বরের ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল যাই যাই করছে। কিচির-মিচির শব্দে একঝাঁক চড়–ই পাখি সজলের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। সজল চিৎ হয়ে শুয়ে দেখল আকাশের এক কোণে সুরমা রংয়ের একখ- মেঘ পাহাড়ের মতো মাথা উঁচু করে ধীরে ধীরে উঠে আসছে। একটি সোনালি ডানার চিল অনেকক্ষণ পাক খাচ্ছে অনেকটা উপড়ে। আস্তে আস্তে বাতাসের জোর বাড়তে লাগল। এক সময় পুরো আকাশ মেঘে মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। হঠাৎ টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে লাগল। অঝরধারার সেই বর্ষণে প্রায় আধা ঘন্টা ভিজল সজল। বৃষ্টি থেমে গেলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে।
সন্ধ্যার টিএসসি’র চত্বর অনেকটা ফাঁকা। তখনও বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী গল্প করছে। কেউবা আবার চা-সিগারেট খাচ্ছে।
সকালে নাস্তার পর তেমন আর কিছু খাওয়া হয়েছে বলে মনে করতে পারল না সজল। বেশ ক্ষুধার তাগিদ অনুভব করল সে। বৃষ্টি হওয়ায় যুৎসই বসার জায়গাও পাওয়া গেল না। শেষটায় রুমাল বিছিয়ে একখ- ইটের ওপর বসে পড়ল সে। ঠা-া হয়ে যাওয়া সিংগারা আর গরম গরম চা খেয়ে সিগারেটের জন্য পকেটে হাত ঢুকাল। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া প্রায় পুরো এক প্যাকেট সিগারেট পকেট থেকে বের করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। একটা রিকশা এসে পুরো প্যাকেটটা চাপা দিয়ে চলে গেল।
নতুন এক প্যাকেট সিগারেট ও একটি দেয়াশলাই কিনল সজল। সিগারেট ধরাতে ধরাতে পকেটে রাখা সেল ফোনটা একবার বেজে উঠে নীরব হয়ে গেল। মিস কল মনে করে প্যাণ্টের পকেট থেকে সেটটা বের করে দেখল, বৃষ্টিতে ভিজে পুরোপুরি অচল হয়ে গেছে সেটটা।
সন্ধ্যা নেমে এল। রাস্তায় সিটি করপোরেশনের বাতিগুলো ম্লান আলো নিয়ে জ্বলে উঠল। অন্ধকার গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতিগুলোর ঔজ্জ্বল্যও বাড়তে লাগল। সোডিয়াম বাতির আলোতে আশপাশের মানুষগুলোকে অনেকটা ভূতের মতো মনে হল সজলের।
অপু ওর এক মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে করতে সজলের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সজলকে এই ভূতূড়ে আলোর মধ্যে চিনতে পারল না। অপু সজলের মোটামুটি ভালো বন্ধু। সজল ভাবল যাক, বাঁচা গেল!
অপু সজলকে চিনতে পারলে হয়ত নানা রকম উত্তর দিতে হত। এই মুহূর্তে সজল পরিচিত কারো সঙ্গেই কথা বলতে চায় না। সে এখন শুধু স্বাতীকে নিয়েই ভাবতে চায়।
ভাবতে ভাবতে অনেক কিছুই ভাবল সজল। আস্তে আস্তে পুরনো দিনগুলো ভেসে উঠল মনের পর্দায়। দুপুরে স্বাতীর সঙ্গে কথাগুলো মনে পড়তেই বুকটা খাঁ-খাঁ করে উঠল। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের ভেতর থেকে। অসহায় বিষণœ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল চলাচলরত মানুষগুলোর দিকে। আজ যেন হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতদিনের চেনাজানা পরিবেশটা খুবই অপরিচিত এবং অনাত্মীয় মনে হল সজলের।
একটা রিকশা ডেকে উঠে বসে আরেকটা সিগারেট ধরাল সজল।
‘কই যাইবেন স্যার?’
রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করল।
‘যেখানে ইচ্ছে যাও।’
‘কী কইলেন?’
‘বলছি, যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও।’
রিকশাওয়ালা কী যেন ভাবল। তারপর রাস্তার এক পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে বলল, ‘আপনি অন্য রিকশায় যান।’
‘কেন?’
‘আপনি তো কইতেই পারেন না কোথায় যাইবেন। আমি আন্দাজে আপনাকে কোনহানে লইয়া যামু?’
‘ঠিক আছে, একটু ঘুরেফিরে এক ঘন্টা কাটিয়ে দাও। তারপর কলাবাগান পৌঁছে দিও।’
‘এক ঘন্টায় দেড়শ’ টাকা লাগবো স্যার।’
‘সমস্যা হবে না। দরকার হলে বখশিশ পাবে। তবে রিকশা আস্তে চালাতে হবে।’
বকশিশের কথা শুনে খুশি মনে আবার রিকশা চালাতে লাগল রিকশাওয়ালা।
এক ঘন্টা পর রিকশা এসে থামল কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাছে। সজল রিকশাওয়ালাকে অতিরিক্ত কুড়ি টাকা দিয়ে বলল, ‘ভালো থেকো’।
রিকশা থেকে নেমে গেলো সজল।
চলবে