তৃতীয় পক্ষ [পর্ব ৩]

 


॥ তিন ॥

নিছার চৌধুরী থানায় পৌঁছে সরাসরি ওসি সাহেবের রুমে ঢুকলেন। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘কেন ডেকেছেন?’

‘এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? বসুন, চা-টা খান। তারপর না হয়...’

‘বাধা দিয়ে নিছার চৌধুরী বললেন, চা আর টা খেতে আসিনি ওসি সাহেব। যা বলার সরাসরি বলুন।’

‘আপনি বোধ হয় আমার ওপর খুব ক্ষেপে আছেন চৌধুরী সাহেব।’

‘ক্ষেপে যাইনি। তবে আপনার ঔদ্ধত্য দেখে আশ্চর্য হয়েছি। ব্রিটিশ আমল থেকে চৌধুরী বাড়ির কাউকে কোনদিন থানায় তলব করা হয়নি। দিনকাল পাল্টে গেছে তো, তাই ব্যাঙও সাপ ধরার সাহস দেখাচ্ছে আজকাল।’ 

‘আমি ঠিক ওভাবে ভাবিনি...’

‘থাক, আর ভাবাভাবির দরকার নেই। বল এখন আপনাদের পায়ে, তাই ইচ্ছে মতন খেলছেন। না হলে এর খেসারত হিসেবে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আপনাকে বান্দরবান যেতে হত।’

‘দেখুন, এখন তো আর সেসব দিন নেই। তাছাড়া...’

‘তাছাড়া কী?’

‘তাছাড়া আমরা বাঙালিরা এখন অসহায়।’

‘ওসি সাহেব, আপনাকে বাঙালি ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমার!’

‘কেন?’

 ‘কেন নয়? গোটা জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, আপনাদের মত দু’চারজন তখনও হানাদারদের পা চাটছেন! চাটুকারদের বাঙালি ভাববো কীভাবে?’

‘দেখুন চৌধুরী সাহেব, নিতান্ত পেটের দায়ে চাকরি করতে হচ্ছে আমাদের।’

‘যদি হাই মনে করেন তাহলে মনে রাখবেন আপনার চাকরির ওই বেতনের টাকা আর যে উর্দি পরে এত তেজ দেখাচ্ছেন, সবই এ দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই মেটানো হয়, পশ্চিমাদের নয়।’

ওসি সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে সরাসরি তাকালেন নিছার চৌধুরীর দিকে। বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না এখন কী করা উচিত।’

ওসি সাহেবের এ কথার উত্তর চট করে খুঁজে পেলেন না চৌধুরী সাহেব। চোখ তুলে তাকালেন তিনি।

‘কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?’

ওসি সাহেব এদিক-ওদিক ভালোভাবে দেখে মাথাটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমিও চাই এ দেশটা স্বাধীন হোক। পশ্চিমাদের গোলামী করতে আর ভালো লাগছে না।’

হো হো করে হেসে উঠলেন চৌধুরী সাহেব। তারপর তীর্যকভাবে তাকালেন ওসি সাহেবের দিকে। বললেন, ‘কথা বের করতে চাচ্ছেন বুঝি? শুনে রাখুন, আমি চাই দেশটা স্বাধীন হোক। পশ্চিমারা আমাদের সবকিছু লুট করে ওদের দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। এটা আর হতে দেওয়া যায় না। আপনি তো জানেন, আমার এক ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। কী জানেন না?

‘জানি।’

‘কার কাছে শুনেছেন?’

ওসি সাহেবকে নিরুত্তর দেখে চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘জয়নাল বেপারীর মতো পোষা কুত্তা থাকতে এ ধরনের খবর জানতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’

‘জ্বি, জয়নাল বেপারীই বলেছে।’

‘তাহলে আর কী কথা শুনতে চান আমার মুখ থেকে? কেন ভণিতা করছেন?’

‘আপনি ভুল বুঝছেন। আমি কোন কথাই বের করতে চাইনি।’

‘তাহলে?’

সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না, এ মুহূর্তে কী করা উচিত আমাদের?’

‘আপনার এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’

‘কেন বিশ্বাস করতে পারছেন না? আপনি তো আমার বাবার বয়সী। আমি কেন আপনার সঙ্গে মিথ্যে বলতে যাবো?’

নিছার চৌধুরী ওসি সাহেবের মুখের দিকে সরাসরি তাকালেন। নিজের বিশ্বস্ত চোখকে কাজে লাগালেন নিপুণভাবে। কেউ মিথ্যে বললে তার চোখের পাতায় ঘন ঘন পলক পড়ে, চেহারার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে কৃত্রিম রাগ অথবা হাসি দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। ওসি সাহেবের চেহারায় এসব লক্ষণের কোনটাই দেখতে পেলেন না নিছার চৌধুরী।

‘এবার চা খাওয়া যেতে পারে।’ নিছার চৌধুরী হেসে বললেন।

‘তাহলে বিশ্বাস করতে পেরেছেন?’

‘আমার বিশ্বস্ত চোখ যদি আমাকে ফাঁকি না দেয়, তাহলে আপনাকে বিশ্বাস করা যায়।’

এরপর ওসি সাহেব চা-বিস্কুটের অর্ডার দিলেন। চা খেয়ে নিছার চৌধুরী ব্রিস্টল সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ঠোঁটে পুরে প্যাকেটটা ওসি সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

ওসি সাহেব ধূমপানে আসক্ত নন। ‘নো থ্যাংকস’ বলে এক গাল হেসে ফিস ফিস করে বললেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে চাই। আপনি আমাকে সাহায্য করুন।’

‘আপনি একা, না অন্য কেউ সঙ্গে আছেন?’

‘সেকেন্ড অফিসার যাবেন। সাথে আরও তিনজন পুলিশ।’

‘আর্মস-অ্যামুনেশন কিছু নিতে পারবেন?’

‘তিনটা রাইফেল ও দুটা পিস্তল নিতে পারব। বেশিও চেষ্টা করা যেতে পারে।’

‘বেশি রিস্ক নেবেন না।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘যেতে হলে তো আগে সুন্দরবন যেতে হবে?’

‘সেটাই নিরাপদ।’

‘যেসব ছেলেরা সুন্দরবন আছে, ওরা আমাদের চিনে ফেলবে। আমার ভয় হচ্ছে, ওরা আমাদের বিশ্বাস করবে না।’

‘যাতে বিশ্বাস করে সে ব্যবস্থা করা যাবে।’

‘কীভাবে?’

‘ওখানে কামাল আছে। ওকে আমি চিঠি লিখে দেব।’

‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। ধন্যবাদ আপনাকে এজন্য যে, আপনার সুমতি হয়েছে।’

ওসি সাহেব মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর নিছার চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে এত সহজে বিশ্বাস করলেন?’

‘করলাম এ জন্য যে, আমার ভয়ের কিছু নেই। আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে আমার সাথে বেঈমানী করেন, তাহলেও আমার ভয়ের কিছু থাকবে না।’

‘কেন?’

‘সবাই জানে আমার বড় ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সুন্দরবন গেছে। আপনিও জানেন।’

‘জয়নাল বেপারী না হলে জানতে পারতাম না।’

‘ওই হারামজাদা আর কী কী বলেছে আপনাকে?’

‘আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনেন, পাশের হিন্দু পরিবারটিকে সময়-অসময়ে সাহায্য করেনÑএসব আর কি।’

‘সবটাই সত্য।’

‘ওই জয়নাল বেপারী থেকে একটু সাবধান থাকবেন।’

‘সে চিন্তা আমি করব। আপনারা কবে যাচ্ছেন?’

ওসি সাহেব কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর সেকেন্ড অফিসারকে ডেকে পাঠালেন। সেকেন্ড অফিসার এলে ওসি সাহেব হাতের ইশারায় বসতে বললেন। অফিসার চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন ওসি সাহেবের দিকে।

‘আমরা কবে যাচ্ছি?’

সেকেন্ড অফিসারকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন ওসি সাহেব।

হঠাৎ এ ধরনের প্রশ্নে ভড়কে গেলেন অফিসার। তিনি একবার চৌধুরী সাহেব একবার ওসি সাহেবের দিকে তাকাতে লাগলেন। সেকেন্ড অফিসারের ভয়ের কারণ দুজনে বুঝতে পারলেন।

নিছার চৌধুরী সেকেন্ড অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে ভয় পেতে হবে না। আজ বা কাল রাতে আপনারা চলে যান। যত তাড়াতাড়ি যাবেন, ততই ভালো, কী বলেন?’

এতোক্ষণে সেকেন্ড অফিসারের মুখে হাসি দেখা গেল। বললেন, ‘কীভাবে, কোথায় যাব?’

নিছার চৌধুরী বললেন, ‘আমি নৌকা ঠিক করে দেব। মাঝির পথঘাট জানা আছে। ও আপনাদের জায়গা মতো পৌঁছে দেবে। আপনারা আপনাদের বিশ্বস্ত দু’একজনকে বলে যাবেন যে, কোন একটা অপারেশনে যাচ্ছেন।’

‘আপনার চিঠিটা?’ ওসি সাহেব নিছার চৌধুরীর দিকে তাকালেন।

‘সময় মতো পেয়ে যাবেন। কবে যাচ্ছেন?’

‘আগামীকাল রাতে।’

‘রাত দশটায় আপনাদের থানার ঘাটে হারুন মাঝি নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করবে। ভালো কথা, আপনাদের বউ-ছেলেমেয়েদের কোথায় রেখে যাবেন?’

‘আমরা দুজনই ব্যাচেলর। ওসব ঝামেলা থাকলে হয়ত ওভাবে চিন্তা করতে পারতাম না। সেকেন্ড অফিসার বললেন।’

নিছার চৌধুরী ওসি সাহেবকে বললেন, ‘আমার বন্দুক তো আপনাদের থানায় জমা।’

ওসি সাহেব বলেন, ‘জি।’

‘আমার একটা কিছু দরকার।’

‘বন্দুক?’

‘বন্দুকে ঝামেলা হবে, বরং একটা রিভলবার হলে ভালো হয়।’

ওসি সাহেব টেবিলের ড্রয়ার খুলে জার্মানীর তৈরি পয়েন্ট টুটু বোরের একটি রিভলবার টেবিলের ওপর রাখলেন।

ঠিক সে মুহূর্তে জয়নাল বেপারী ওসি সাহেবের রুমে উপস্থিত হলে বেপারীকে দেখে ওসি সাহেব পুরোপুরি পাল্টে গেলেন। টেবিল থেকে পিস্তলটা উঠিয়ে পরখ করতে করতে খুব কড়া ভাষায় নিছার চৌধুরীকে বললেন, ‘আগামী তিনদিনের মধ্যে আপনার ছেলেকে থানায় হাজির করবেন। না পারলে আমি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। আর শুনুন, এরপর থেকে আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনবেন না।’

নিছার চৌধুরীও পরিস্থিতি বুঝে ওসি সাহেবকে কড়া ভাষায় বললেন, ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

‘আপনি ভয় পেলে আমার কিছু করার নেই। আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।’

‘ধমক শুনতে আমি অভ্যস্ত নই ওসি সাহেব।’ নিছার চৌধুরী গর্জে উঠলেন।

ওসি সাহেবেও কম যান না। টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটা উঠিয়ে খুব জোরে টেবিলের ওপর রেখে একটা শব্দ করে বললেন, ‘আমরা পাকিস্তানকে রক্ষা করবই। দু’চারজন দু®কৃতকারীকে আমরা পরোয়া করি না।’

কাকে দু®কৃতকারী বলছেন, ‘আমাকে?’

‘যদি মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করেন তো আপনিও আমার চোখে দুষ্কৃতকারী।’

জয়নাল বেপারী এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে এসব দেখে খুবই মজা পাচ্ছিল। এবার সে নিছার চৌধুরীর পক্ষ নিয়ে বলল, ‘চৌধুরী সাহেবের ছেলে যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও থাকে সে জন্যে ওনাকে দোষারোপ করছেন কেন ওসি সাহেব?’

‘জয়নাল সাহেব, আমি ওনাকে কড়াভাবে কিছুই বলতে চাইনি। প্রায় এক ঘন্টা ধরে ওনাকে বোঝাচ্ছি আমি। সেই থেকে উনি আমার ওপর চড়াও হয়ে কথা বলছেন। আমারও তো সহ্যের সীমা আছে, নাকি?’

জয়নাল বেপারী ওসি সাহেবকে বললেন, ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না স্যার। আমি ওনার ব্যাপারটা দেখছি। চলুন ভাইজান, আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’

জয়নালকে উদ্দেশ করে নিছার চৌধুরী বললেন, ‘তুমি আবার আমার কী দেখবে! কী পেয়েছো তোমরা আমাকে? হাতি খাঁদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারতে চায়! কি তাই না?’

জয়নাল বেপারী এর কোন উত্তর খুঁজে পেল না। নিছার চৌধুরী ওসি সাহেবকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘চলি ওসি সাহেব। তবে যাবার আগে একটা কথা বলে যাই, আমিও এর শোধ নেব।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নিছার চৌধুরী। তারপর একবার ওসি সাহেব এবং একবার জয়নাল বেপারীর দিকে তীর্যক দৃষ্টি হেনে থানা থেকে বের হয়ে গেলেন।

ওসি সাহেব কৃত্রিম রাগে পেপার ওয়েটটা উঠিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে মারলে সেটি টেবিলের নীচে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় থেমে গেল।


চলবে

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url