কাজীদার গল্প [পর্ব ১]
বাংলার কবি, বাঙালির কবি কাজী নজরুল
বাঙালির কবি বলতে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। তারপরই কাজী নজরুল ইসলাম। তার বেশ কিছু চিত্র ফুটে ওঠে আমাদের সামনেÑহাবিলদার বেশে নজরুল, সেতার কোলে নজরুল ইসলাম এবং তার অসুস্থতার চিত্রগুলো আমাদেরকে ব্যথিত করে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নজরুলকে ‘বাংলার কবি, বাঙালি কবি’ বলে অভিহিত করেছিলেন ১৯২৯ সালে। কলকাতার তৎকালীন অ্যালবার্ট হল বা বর্তমানের কফি হাউসে নজরুলকে দেওয়া সংবর্ধনায় আচার্য রায় নজরুলকে এই উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তার গান গাইব।’
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহাকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামের খড়ের ছাওয়া এক মাটির ঘরে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (২৪শে মে, ১৮৯৯) কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। সেই মাটির ঘরের পূর্বদিকে ছিল রাজা নরোত্তমের গড়, দক্ষিণে পীরপুকুর, পুকুরের পূর্বপাড়ে হাজি পালোয়ানের মাজার এবং পশ্চিম পাড়ে মসজিদ।
নজরুলের বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মায়ের নাম ছিল জাহেদা খাতুন। নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন নজরুলের বাবা কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী। কবির পিতামহ কাজী আমিনুল্লাহ। মাতামহ তোফায়েল আলী। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নাম ছিল কাজী সাহেবজান। কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাজী আলী হোসেন এবং বোন উম্মে কুলসুম। নজরুলের ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। আরো কিছু নামে ডাকা হতো বা লোকে চিনতে নজরুল ইসলামকে। সাধারণত মনে করা হয় দারিদ্র্যের প্রবল কষাঘাতে শৈশব পার হয়েছে বলে নজরুলের নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। এটা হয়তো ঠিক নয়। তার মা-ই ভালো জানতেন কেন নজরুলের নাম ‘দুখু মিয়া’ রাখা হয়েছিল। আমরা যেটুকু জানি তা হলো, মা জাহেদা খাতুনের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হয় বলে তার নাম রাখা হয় ‘দুখু মিয়া’। ছেলেবেলায় তিনি ‘তারা ক্ষ্যাপা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। পরে ‘নূরু’ নামও তিনি ব্যবহার করেছেন। নজরুলের শাশুরি তাকে নূরু নামে ডাকতেন।
করাচি সেনানিবাসে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও তরুণ নজরুলের সাহিত্য-সংগীত অনুরাগী মন শুকিয়ে যায়নি, বরং অদম্য আগ্রহে পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। প্রাণবন্ত হইহুল্লোড়ে আসর জমাতেন বলে সেনানিবাসে তিনি ‘হৈহৈ কাজী’ নামে পরিচিত ছিলেন।
জন্মের পর পর নজরুল ইসলাম চরম দারিদ্রের মধ্যে পড়েন। ১৯০৮ সালে নজরুলের বাবা কাজী ফকির আহমদ মারা যান। তখন নজরুলের বয়স মাত্র নয় বছর। দশ বছর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্নপ্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর গ্রামের মক্তবের শিক্ষকতা, হাজী পালোয়ানের মাজারে খাদেম এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজে নিযুক্ত হন। পিতার মৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য নজরুলকে এসব দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।
নজরুলের চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন ওই অঞ্চলের লেটো দলের নামকরা ব্যক্তি। আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষায় তার অগাধ জ্ঞান ছিল। চাচার কাছ থেকে নজরুল ফারসী ও উর্দু ভাষা শিখেছিলেন। এছাড়াও কাজী বজলে করিম মিশ্রভাষায় কবিতা ও গান রচনা করতেন। চাচার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে লেটো দল নজরুলকে আকর্ষণ করেছিল। নজরুলের কবি ও সংঙ্গীত জীবনের শুরু ওই লেটো দল থেকেই। লেটোদলের জন্য পালাগান রচনা করতে গিয়েই হিন্দু পুরাণের সঙ্গেও নজরুলের পরিচয় ঘটেছিল। লেটো দলের কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি চাষার সঙ, শকুনি বধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ্, কবি কালিদাস, বিদ্যাভুতম, রাজপুত্রের সঙ, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।
লেটো দলের পর ১৯১০ সালে নজরুল পুনরায় ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। তাকে প্রথমে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ঐ স্কুল ছেড়ে নজরুল মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল বা নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সে সময়ে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। তিনি তার ছাত্র নজরুল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবেÑ‘বেশ সুন্দর ছেলেটি, আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড়ো লাজুক ছিল।’ কিন্তু আর্থিক কারণে ষষ্ঠ শ্রেণির পর ছাত্র জীবনে আবার বিঘœ ঘটে নজরুলের। মাথরুন স্কুল ছেড়ে তিনি সম্ভবত প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে যোগ দেন। তারপর বর্ধমান-অন্ডাল ব্রাঞ্চ রেলওয়ের এক খ্রিস্টান গার্ড সাহেবের খানসামার এবং শেষে আসানসোলের এক বেকারি ও চা-এর দোকানে কাজ করেন। এভাবে দারিদ্র্যের কারণেই স্কুলের পড়াশুনা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
আসানসোলের চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় তিনি দারোগা রফিজউল্লাহর সঙ্গে পরিচিত হন। দারোগা সাহেবের অনুগ্রহে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। দরিরামপুর স্কুলের পর নজরুল পুনরায় নিজের এলাকায় ফিরে যান এবং সম্ভবত ১৯১৫ সালে প্রথমে নিউ স্কুল বা অ্যালবার্ট ভিক্টর ইন্সটিটিউশনে এবং পরে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সাল একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৭ সালের জুলাই মাসের পর সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। নজরুলের ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি সিয়ারসোল রাজ স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণ চন্দ্র ঘটক, ফারসি ভাষায় ফারসি শিক্ষক হাফিজ নূরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় প্রধান শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়।
নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর প্রশিক্ষণের জন্যে প্রথমে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম, পরে লাহোর হয়ে নওশেরা এবং ট্রেনিং শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন অতিবাহিত হয়। ১৯১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন বছর তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এ সময়ে তিনি সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সেনাবাহিনীতে সৈনিক জীবনের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেও তার সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত ছিল। এই সময়ে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলভীর কাছে তিনি ফারসি শেখেন। তিনি সৈনিকদের বিনোদনের জন্যে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য চর্চাও অব্যাহত রাখেন। করাচি সেনানিবাসে রচিত এবং কলকাতায় পাঠানো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুল রচনার মধ্যে ছিল ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ নজরুলের প্রথম প্রকাশিত রচনা (সওগাত, মে ১৯১৯), প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, জুলাই ১৯১৯), করাচিতে রচিত অন্যান্য রচনা গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’, কবিতা ‘আশায়’ এবং ‘কবিতা-সমাধি’ প্রভৃতি। করাচিতে সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার সমকালীন প্রধান প্রধান সাহিত্য পত্রিকা যেমন প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, সবুজপত্র, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রভৃতির গ্রাহক ছিলেন। এছাড়াও তার কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং ফরাসি কবি হাফিজের কিছু গ্রন্থও ছিল। ফলে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্য চর্চার শুরু আসলে করাচি সেনানিবাস থেকেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাওয়া হয়নি। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
নজরুলের ভাইবোন
কাজী ফকির আহমেদ-এর প্রথম স্ত্রীর নাম কাজী সৈয়দা খাতুন। তিনি চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার গর্ভের একমাত্র কন্যা সাজেদা খাতুন। সৈয়দা খাতুনের মৃত্যুর পর ফকির আহমদ বিবাহ করেন জাহেদা খাতুনকে। তিনি চুরুলিয়ার পার্শ্ববর্তী ভূড়ি গ্রামের উচ্চবংশজাত মহিলা ছিলেন। তিনি অতি দয়াবতী রমণী ছিলেন। জাহেদা খাতুনের গর্ভে তিন পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলি হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান পিতার দারিদ্রবশত উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। পিতার মৃত্যুর পর অন্নসংস্থানের জন্য রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে চাকরি নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন কয়লা খনিতে নিযুক্ত থাকায় তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে এবং অসুখে ভুগে পঞ্চাশ বছর বয়সে মারা যান। কাজী সাহেব জান অবসরে দলিল লেখকের কাজ করতেন।
বুদ্ধদেব বসু নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন
খ্যাতিমান সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন, “নজরুল ছিলেন একাই একশো। চওড়া মজবুত জোরালো তার শরীর, লাল-ছিটে লাগা বড়ো-বড়ো মদির তার চোখ, মনোহর মুখশ্রী, লম্বা ঝাঁকড়া চুল তার প্রাণের ফূর্তির মতোই অবাধ্য, গায়ে হলদে কিংবা কমলা রঙের পাঞ্জাবি এবং তার ওপর কমলা কিংবা হলদে রঙের চাদর, দুটোই খদ্দরের। ‘আপনি রঙিন জামা পরেন কেন?’Ñকেউ জিজ্ঞেস করলে, উত্তরে নজরুল বলতেন, ‘সভায় অনেক লোকের মধ্যে যাতে চট করে চোখে পড়ে তাই...!’ এ কথা বলে হো হো করে হেসে উঠতেন তিনি। কথার চেয়ে বেশি তার হাসি, হাসির চেয়ে বেশি ছিল তার গান। একটি হারমোনিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমাণে চা এবং অনেকগুলো পান নিয়ে বসে সব ভুলে পাঁচ-ছয়-সাত ঘণ্টা একনাগাড়ে গান করতে পারতেন কাজী দা। নজরুল যে ঘরে আড্ডা জমাতেন, সে ঘরে আর কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতো না।”
নাসির আহমেদ কাবুল
২০২৪