খাঁচার পাখি ও বনের পাখি


ছোট্ট অন্তু ডানপিটে খুব। বয়স বারো পেরোয়নি এখনও। তবু কী যে দুঃসাহস ওর! ভাবতে অবাক লাগে। একা একা ঘুরে বেড়াবে সকাল-দুপুর সন্ধ্যায়। বড় বড় গাছের মগডালে উঠবে। নারকেল গাছের কোটর থেকে পাখির বাচ্চা তুলে আনবে সুযোগ পেলেই। কেউ যদি বলে, ‘অন্তু গাছের কোটরে সাপও থাকতে পারে। অন্তু হেসে উড়িয়ে দেয় সে কথা। বলে, ‘কী যে বলো না! সাপ থাকলে সেখানে পাখি থাকে নাকি?’

নদীর জলে ঝাঁপ দেয় অন্তু।

ওর মা বলে, ‘ডুবে যাবি বাপ আমার!’

অন্তু খিল খিল করে হেসে ওঠে। ‘মাগো তুমি কী যে বলো না! তোমার অন্তু বড় হয়েছো তো!’

অন্তু বন-বাদারে ঘুরে বেড়াবে। ঢেঁকির শাক তুলে এনে মাকে দেবে। খাল আর বিল থেকে মাছ ধরবে। বাড়ির পাশে বিশাল ঝিল থেকে শাপলা তুলে আনবে। অন্তুর কাজের কি কোন শেষ আছে! 

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ঘুড়ি ও লাটাই নিয়ে দৌড়ে যাবে মাঠে। অন্তুর নিজ হাতে বানানো ঘুড়ি সবার চেয়ে আলাদা। লাল আর সবুজ রঙ মিলিয়ে অন্তু ঘুড়ি বানায়। অন্তু নিজেই বলে, ‘আমার ঘুড়ি বাংলাদেশের পতাকা।’

অন্তু নিজের দেশ নিয়ে খুব গর্ব করে। বই পড়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা জেনেছে অন্তু। অন্তুর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবাকে নিয়ে অন্তুর অহংকারের শেষ নেই। অন্তু বলে ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার ছেলে, আমার ঘুড়ি সব সময় লাল আর সবুজ রঙের হবে।’ 

তবে ডানপিটে অন্তু লেখাপড়ায় খুব ভালো। পরীক্ষায় প্রথম হওয়া চাই ওর। একদিনের জন্যও স্কুল কামাই করে না অন্তু। খেলাধূলায়ও সেরা ও। হাডুডু, দারিয়াবান্দা, ফুটবল টিমের এক নম্বর খেলোয়ার অন্তু। ক্রিকেটও খুব ভালো খেলে ও। স্কুলের স্যাররাও ওর খুব তারিফ করেন। ভালোবাসেন খুব।

অন্তু বাঁশ ও বেত দিয়ে পাখির খাঁচা বানালো নিজের হাতে। তারপর গাছের কোটর থেকে একজোড়া শালিক ছানা নিয়ে এলো একদিন। আপাতত ঘুড়ি উড়ানো বন্ধ হলো অন্তুর। নদীর জলে সাঁতার কাটতেও যাওয়া হয় না আগের মতো আর। স্কুল আর লেখাপড়া শেষে পাখির ছানা নিয়েই মেতে থাকে সারাদিন। 

অন্তু মাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মাগো শালিক ছানা কী খায়?’

মা বললেন, ‘ঘাস ফড়িং।’

অন্তু আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘আর কী কী খায়?’

‘ভাত খায়, কলাও খায়’ -মা বললেন।

অন্তু মাঠ থেকে ঘাস ফড়িং ধরে এনে ছানা দু’টিকে খাওয়ায়। বাগান থেকে কলার গোটা ছড়া কেটে এনে শালিক পাখির জন্য রাখে।

‘মাগো শালিক পাখি কথা বলবে তো? ময়না যেমন বলে।’ অন্তু মাকে জিজ্ঞেস করে।

মা মাথা নেড়ে বলেন, ‘বলবে। বড় হলেই ওরা কথা বলবে।’

অন্তু শালিক পাখির কথা শোনার জন্য অস্থির হয়। দিন যেন কাটতে চায় না কিছুতেই। ধীরে ধীরে শালিক পাখি দু’টি বড় হতে থাকে। অন্তু একদিন লক্ষ্য করলো পাখি দু’টি মানুষের মতো শিষ দিচ্ছে। খুশিতে ডগবগ অন্তু মাকে সে কথা জানায়। মাও দৌড়ে আসেন শালিক দু’টির কাছে। শালিক পাখি আবার শিষ দেয়। মা খুশি হন।

অন্তু মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘মাগো শালিক পাখি কী বলে ডাকবে আমাকে?’ 

মা বলেন, ‘কী ডাকলে খুশি হবি তুই?’

অন্তুবলে, ‘যদি ভাইয়া বলে ডাকতো। আমার তো আর ভাইবোন নেই। তাই আমাকে কেউ ভাইয়া বলে ডাকে না! আমার বন্ধু শান্তরা তিন ভাইবোন। ওর ছোট বোনটি ওকে ভাইয়া বলে ডাকে।’

অন্তু মন খারাপ করে। মা বুঝতে পারেন ছেলের কষ্ট। সান্ত¦না দেন তিনি। ‘তুমি দেখো, শালিক পাখি একদিন তোমাকে ভাইয়া বলেই ডাকবে।’

অন্তু খুশি হয়।

হঠাৎ একদিন এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। একটি বিড়াল খাঁচার বাইরে থেকে পা ঢুকিয়ে একটি শালিককে খাঁমচে দেয়। রক্তাক্ত হয় শালিকটি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয় পাখিটি। তার কয়েকদিন পর শালিকটি মারা যায়।

অন্তুর কান্না যেন কিছুতেই থামতে চায় না। মৃত পাখিটি সামনে রেখে কেঁদে কেঁদে দিন কাটায়। মা অন্তুকে সান্ত¦না দেন, ‘কাঁদছিস কেন, একটি তো আছে। এখন থেকে খাঁচাটা এমনভাবে রাখতে হবে যেন বিড়াল আর ছুঁতে না পারে।’

অন্তু তাই করলো। 

জোড়া শালিকের একটি মারা গেলে অন্য পাখিটিও মন মরা হয়ে পড়ে। অন্তু সেটা লক্ষ্য করে। খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে শালিকটিকে সান্ত¦না দেয় অন্তু - ‘আরে বোকা মন খারাপ করিস কেন? আমি তো আছি। তোর সঙ্গে আমি কথা বলবো, গল্প করবো। দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে।’

অন্তু যখন কথা বলে পাখিটি তখন অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্তু ভাবে পাখিটি ওর সব কথা বুঝতে পারে। 

একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ঘরে এসে অন্তু দেখে খাঁচার পাশে আরও একটি শালিক এসে বসেছে। দু’টি পাখি কিচিরমিচির শব্দ করে কীসব কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। পাখির ভাষা কী আর মানুষ বুঝতে পারে কখনও! তবু অন্তুর মনে হয়, বনের পাখিটি খাঁচার পাখিটিকে বলছে, ‘ও খাঁচার পাখি ভাই, তুমি একা বুঝি?’

খাঁচার পাখি বলে, ‘একাই তো! আমার বন্ধুটিকে একটা দুষ্টু বিড়াল মেরে ফেলেছে। তাই তো আমি একা। তবে আমার এক বন্ধু আছে। অন্তু ওর নাম। ওই তো আমাকে এখানে এনেছে। জানো তো ও আমাকে খুব আদর করে।’

‘তোমাকে খেতে দেয়?’ বনের পাখি জিজ্ঞেস করে।

খাঁচার পাখি বলে, ‘দেয়ই তো! কতকিছু খেতে দেয়। ঘাসফড়িং, পোকামাকড়, কলা। আর কি খেতে দেয় জানো? ভাত দেয়। ভাত খেতে খুব মজা। তুমি খেয়েছো কখনও?’

বনের পাখির বলে, ‘নাতো, ভাততো খাইনি কখনো।’

খাঁচার পাখি বলে, তাহলে তুমিও আসো আমার কাছে। দু'জনে একসঙ্গে থাকি। কী সুন্দর খাঁচা, তোমার খুব ভালো লাগবে। কতো মজার মজার খেতে পারবে।’

বনের পাখি বলে, পাগল হয়েছো তুমি! এতো সুন্দর আকাশ, গাছপালা এসব ছেড়ে তোমার ছোট্ট খাঁচায় আসবো আমি! তার চেয়ে তুমি এসো, দু’জনে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবো। গল্প করবো। কত আনন্দ করবো আমরা।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে খাঁচার পাখি। বলে, ‘এতো শক্ত খাঁচা থেকে কেমন করে বের হবো আমি!’

বনের পাখি বলে, তাই তো! আচ্ছা তুমি কি গান গাইতে পারো?

খুশি হয়ে খাঁচার পাখি বলে, ‘পারি তো। এই শোন আমি গাইছি।’

হঠাৎ শিষ দিয়ে ওঠে খাঁচার পাখিটি।

খাঁচার পাখির শিষ দেয়া দেখে হেসে লুটিয়ে পড়ে বনের পাখিটি। বলে, ‘তুমি খুব বোকা! এতো মানুষের গান। বনের গান জানো তুমি?’

খাঁচার পাখি বলে, ‘নাতো!’

বনের পাখিটি বলে, ‘তাহলে শোন আমি বনের গান গাইছি।’

বনের পাখিটি অনেকক্ষণ কিঁচিরমিচির করে গান গায়। অবাক হয়ে শোনে খাঁচার পাখিটি।

গান থামিয়ে বনের পাখি বলে, ‘তুমি আমার সঙ্গে বনে যাবে?’

অসহায়ভাবে তাকায় খাঁচার পাখি। বলে, ‘না যেতো পারবো না। অন্তু আমাকে যেতে দেবে না।’

তুমি না বললে, অন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে। ওকে বলো ওই তোমাকে ছেড়ে দেবো। ভালোবাসলে কেউ কি কখনো কাউকে বন্দী করে রাখে?’

খাঁচার পাখিটি কিছুক্ষণ ভাবলা। তারপর বলল, ‘অন্তু আমাকে কিছুতেই ছেড়ে দেবে না।’

অন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো শোনে। মন খারাপ হয় অন্তুর। মাকে ডেকে এনে দেখায় পাখি দু’টিকে।

বনের পাখিটি অন্তু ও ওর মাকে দেখে উড়ে চলে যায়। অন্তু মাকে নিয়ে খাঁচার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্তুর হঠাৎ মনে হয় শালিক পাখিটি মন খারাপ করে বসে আছে।

অন্তু হঠাৎ যেন বদলে গেলো। মাকে বলল, ‘মাগো খাঁচার মধ্যে পাখিটির কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’

মা বললেন, ‘হঠাৎ তোর এ রকম মনে হলো কেন রে?’

অন্তু বলল, ‘দ্যাখো না, বনের পাখিটি চলে যাওয়ার পর ও কেমন মন খারাপ করে আছে।’ 

মা বললেন, ‘কষ্ট তো হবেই। তোমাকে যদি কেউ বন্দী করে রাখে, আমাদের কাছ থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যায়, তাহলে তোমার কষ্ট হবে না? আমাদের কাছে আসতে মন চাইবে না তোমার?’

অন্তু বলল, ‘তাইতো! তোমাকে ছাড়া আমি কোথাও একদিনও থাকতে পারবো না।’

মা হেসে বললেন, ‘পাখিটারও তো আপনজন আছে। মা আছে। ওদের ছেড়ে থাকতে ওর কষ্ট হওয়াই তো স্বাভাবিক।’

অন্তু মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল, ‘মা আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি ওকে ছেড়ে দেবো। আমি চাই ও ওর মায়ের মায়ের কাছে ফিরে যাক।’

মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোর মন খারাপ করবে না?’

অন্তু বলল, ‘না মা। বরং ওর মন খারাপ দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি ওকে বনেই ছেড়ে দেবো।’

মা খুশি হয়ে বললেন, ‘জানো তো বন্যেরা বনে সুন্দর, আর শিশুরা মায়ের কোলে।’ 

অন্তু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। তারপর খাঁচার দরজা খুলে পাখিটা হাতে নিয়ে দু’তিনবার পাখিটার ঠোঁটে চুমু খেয়ে শূন্যে উড়িয়ে দিলো। পাখিটার উড়ে যাওয়া নিষ্পলক তাকিয়ে দেখলো অন্তু। তারপর মাকে বলল, ‘মা আমি ঠিক কাজ করেছি তো?’

মা বললেন, ‘ঠিক করেছো। বনের পাখিকে কখনো খাঁচায় বন্দী করে রাখতে নেই। নিজের ভালোলাগার জন্য অন্যকে কষ্ট দিতে নেই।’

পরিতৃপ্তির হাসি হাসলো অন্তু। বলল, ‘মা আমি আর কখনো কোন পাখিকে বন্দী করে কষ্ট দেবো না।’

মা ছেলেকে কোলে টেনে নিয়ে চুমো খান। আদর করেন।


[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই পাখি’ কবিতার ছায়া অবলম্বনে]
২৩ মার্চ, ২০১২


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url