শিশুর বেড়ে ওঠার জন্যে দরকার সুস্থ সামাজিক পরিবেশ


বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান অনীক। বয়স ৭ বছরের কিছু বেশী। অনীক রাজধানীর একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। হাসি-খুশী প্রাণবন্ত ও মেধাবী উৎস কোনদিনই স্কুল কামাই করে না। এ জন্যে শিক্ষকরাও তাকে স্নেহ করেন। স্কুলে গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে খুব পছন্দ তার। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে স্কুলে যাবে না বলে জানায়। বাবা-মা দু’জনে এর কারণ জানতে চাইলে অনীক জানালো তার লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না। ওর মা বুঝিয়ে-শুনিয়ে ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে চেষ্টা করলেন। এতে কোন ফল হলো না দেখে তিনি ছেলের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন। এতে ফল হলো বিপরিতÑ অনীক আস্তে আস্তে অন্যদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। কারো সঙ্গেই সে আর আগের মতো কথা বলে না। কোন কথা জিজ্ঞেস করলে মাঝে-মধ্যে উত্তর দেয়। বাকী সময়টা সে নীরব হয়ে থাকে।

অনীকের বাবা-মা শিক্ষিত। দুজনেই চাকরি করার কারণে ছেলেকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। তারা ভাবলেন কিছুদিন ছেলেকে সময় দিলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। উপায়ন্তর না দেখে তারা  মনোবিজ্ঞানীর স্মরণপন্ন হলেন। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানী ড. কে আর জামান উৎসকে পরীক্ষা করে বললেন, উৎস বিষণœতার শিকার। সব সময় হাসি-খুশী শিশুটি কেন বিষণœতার শিকার হবেÑ এ প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার বললেন, শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্যে সুন্দর পরিবেশ দরকার। সুস্থ্য বিনোদন এবং খেলাধুলা ও বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য না পেলে অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা সবকিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। এর ফল অনেক সময় মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

আমাদের দেশে বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোতে শিশুদের খেলাধুলার কোন পরিবেশ নেই। সারাদেশে শিশুদের জন্যে যে ক’টি শিশু পার্ক রয়েছে তার অধিকাংশ গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেক শিশু পার্ক বড়দের আড্ডাস্থলে পরিণত হওয়ায় শিশুরা সেখানে তার অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। এছাড়াও বড়রা শিশুদের খেলাধুলায় বাধা সৃষ্টি করছে। কিছুদিন আগে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার ১১ বছরের শিশু আসিফ বড়দের হাতে লাঞ্ছিত হয়। এক সন্ত্রাসী তাকে বেদম পেটানোর পর প্রায় মুমুর্ষু অবস্থায় তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে সুপারিশ করেন। সেখানে অবস্থা আরো খারাপ হলে আসিফকে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর আসিফ সুস্থ্য হয়ে উঠলেও মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। আসিফের অপরাধ ছিলো বন্ধুরা মিলে যখন বাড়ির পাশে মাঠে ক্রিকেট খেলছিল, তখন কয়েকজন যুবক ওদের মাঠ দখল করে নিজেরা খেলতে চাইলে আসিফ বাধা দেয়। এতেই ওই যুবকদের রোষানলে পড়ে আসিফ। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে যুবকরা আসিফকে জখম করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। এক পথচারী দেখতে পেয়ে আসিফের বাড়িতে খবর দিলে তারা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করেন।

এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশে শহর-বন্দর-গ্রামে শিশুদের প্রতি এ ধরনের সহিংসতা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এসব ঘটনার খুব কমই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে বিষয়টির মীমাংসা করা হয়। এসব ঘটনার বিচারে স্থানীয়ভাবে শালিসী ব্যবস্থায় অর্থদন্ড দেয়া হয়; যা অপরাধীর অভিভাবক বহন করেন। ফলে অপরাধীকে কোন ধরনের শাস্তি পেতে হয় না বলে পরবর্তীতে সে এ ধরনের কাজে আবারো জড়িয়ে পড়ে।

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে দরকার খেলাধুলা। গ্রামে শিশুরা খেলাধুলার স্থান পেলেও শহরে তা একেবারেই সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে শিশুদের দিনের পর দিন চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী  থাকতে হয়। ঘরের মধ্যে তারা হয় টিভিতে কার্টুন দেখে কিংবা কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলে সময় কাটায়। এতে তাদের চোখের ওপর চাপ সৃষ্টি হলে এক পর্যায়ে তাদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। ফলে খুব কম বয়সে শিশুরা চশমার সাহায্য নিতে বাধ্য হয়। 

শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে পুষ্টিকর খাদ্যের যেমন প্রয়োজন, তেমনি খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনেরও প্রয়োজন সমধিক। অভিভাবকরা শিশুদের পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তার জন্যে অনেকটা তৎপর হলেও মানসিক পুষ্টির দিকটি একেবারেই উপেক্ষিত থেকে যায়। এ জন্যে শারীরিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় না বলে শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। 

শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্যে খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যে সবার আগে অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সতর্ক হতে হবে। প্রতিটি বাড়িতে শিশুদের খেলার জন্যে জায়গা রাখতে হবে। স্কুলে খেলার মাঠ ও কমন রুমসহ লাইব্রেরীর ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতি বছর ইনডোর খেলাধুলাসহ ফুটবল, ক্রিকেট খেলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও স্কুলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি আন্ত: ক্লাস বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলে শিশুরা ক্লাসের বইয়ের জ্ঞানের বাইরে আরো বেশী জ্ঞানার্জনে উৎসাহী হয়ে উঠবে। গ্রামের প্রতিটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। শহরের শিশু পার্কগুলো শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়াও স্কুলে শরীর চর্চা ও ক্রীড়া প্রশিক্ষণের জন্যে আলাদা শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। মানসিক বৃদ্ধির জন্যে শিশুদের জন্যে সুস্থ বিনোদন অপরিহার্য। টিভি চ্যানেলগুলোতে বেশী করে শিশুতোষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে। সর্বোপরি শিশুবান্ধব আইন প্রণয়ন করে শিশুরা যাতে কোন ক্ষেত্রে উপেক্ষিত না হয় সে দিকটা নিশ্চিত করতে সকলকে আরো বেশি বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে।


লেখক : নাসির আহমেদ কাবুল
ইউনিসেফ ফিচার






Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url