নজরুলের পেশা ও নেশা [পর্ব ৩]
গ্রামোফোন কোম্পানীতে নজরুল
সময়টা ১৯২৮। গ্রামোফোন কোম্পানিতে তখন মিউজিক ট্রেনার ধীরেন্দ্রনাথ দাস। ইনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও সংগীতশিক্ষক। ঐ সময় সদ্য বেরোনো একটি রেকর্ডের দুটি গান একেবারে অন্য ধরনের আভাস নিয়ে এলো ধীরেনবাবুর কানে। গান দুটির গায়ক তখনকার অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী কে. মল্লিক। এটা তার ছদ্মনাম, তার আসল নাম মহম্মদ কাসেম। বর্ধমানের কুসুম গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে আশ্রয় পেয়েছিলেন চিৎপুরের জমিদার গোরাচাদ মল্লিকের কাছে। তারই সাহচর্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় কাসেমের সংগীতপ্রতিভা বিকশিত হয়। রেকর্ডে যখন গাইতে শুরু করলেন, কাসেমের ‘কে’ ও গোরাচাদ মল্লিকের ‘মল্লিক’ মিলিয়ে নাম নিলেন ‘কে. মল্লিক’।
তখন থেকে অনেক পরবর্তীকালঅবধিও রেকর্ডে গীতিকার-সুরকারের নাম উল্লেখ থাকত না। শুধু থাকত কণ্ঠশিল্পীর নাম। ধীরেন দাস গান দুটি শুনে কে. মল্লিককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, গান দুটি কোথা থেকে পেয়েছেন তিনি, কার লেখা ও সুর। তাকে একবার কোম্পানিতে কি নিয়ে আসা যায়? কে. মল্লিক বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, এ গান যার, তিনি আপনভোলা একজন অদ্ভুত মানুষ। চাইলেই তার খোঁজ পাওয়া মুশকিল। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই খোঁজ পাওয়া গেল গীতিকারের ।
তখন গ্রামোফোন কোম্পানির স্টুডিও ও দফতর ছিল বেলেঘাটায়। একদিন কে. মল্লিক, ধীরেন দাস ও কোম্পানির তখনকার মার্কেটিং রিপ্রেজেন্টেটিভ ভগবতীচরণ ভট্টাচার্য বউবাজার স্ট্রিট (বর্তমান বি.বি. গাঙ্গুলি স্ট্রিট) ধরে শিয়ালদহ হয়ে বেলেঘাটার দিকে হাঁটছিলেন। হঠাৎ কোলে মার্কেট অঞ্চলে বউবাজার স্ট্রিট ও আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) সংযোগস্থলে একটা পানের দোকানে ঝাঁকড়া চুলের একজন সুদর্শন মানুষকে পান কিনতে দেখে কে. মল্লিক বলে উঠলেন, ‘এই তো সেই লোকÑকাজী নজরুল ইসলাম! আমার গানদুটো যার লেখা।’
১৯২৮ সালের মার্চ মাসে নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানি ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’-এর সাথে যুক্ত হন। এইচএমভি-তে নজরুল সংগীতের প্রথম রেকর্ড করা শিল্পীর নাম শ্রী হরেন্দ্রনাথ দত্ত। রেকর্ড করা নজরুল ইসলামের প্রথম গান ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছ জুয়া’।
এইচএমভি থেকে রেকর্ড করা নজরুল ইসলামের প্রথম ইসলামি গান- ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ইদ’, শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ গানটি রেকর্ড করেন। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ সাল। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে কাজী নজরুল ইসলাম লেখা প্রায় ২ হাজার গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল। তৎকালীন বাংলার ২৮টি জেলায় তার গান বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কাজী নজরুল ইসলামের রেকর্ড করা প্রথম শ্যামাসংগীতটি হলো- ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়’। শিল্পী মৃণাল কান্তি ঘোষের গানটি ১৯৩২ সালের জুন মাসে রেকর্ড করা হয়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম রেকর্ডকৃত নাটক ছিল ‘ইদুল ফেতর’। নজরুলের জীবনের শেষ রেকর্ড করা গান দুটি হলো : ১. চীন ও ভারত মিলেছে; ২. সংঘশরণ তীর্থযাত্রা পথে। গান দুটি গেয়েছিলেন শিল্পী সত্য চৌধুরী ও জগন্ময় মিত্র।
এইচএমভি কোম্পানির ইলেকট্রিক রেকর্ডিং
১৯২৮ সালে এইচএমভি কোম্পানি ইলেকট্রিক রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার উদ্বোধন করেন। কবি নজরুল ইসলাম নিজ কণ্ঠে দুটি কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড করেন। কবিতা দুটি হলো : ‘নারী’ এবং ‘রবিহারা’। সেপ্টেম্বর, ১৯৪১Ñকবি নজরুল ইসলাম তাঁর নিজ কণ্ঠে ৬টি গান রেকর্ড করেছিলেন। গানগুলো হলোÑ
১. দিতে এনে ফুল হে প্রিয় (৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩২)
২. পাষাণে ভাঙালে ঘুম (৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩২)
৩. কেন আসিলে ভালোবাসিলে (এপ্রিল, ১৯৩৩)
৪. দাঁড়ালে দুয়ারে মোর (এপ্রিল, ১৯৩৩)
৫. ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে (কবির সাথে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ইলা মিত্র এবং সুনীল ঘোষ)।
৬. এ কী সুরে তুমি গান শোনালে (রেকর্ড নং পাওয়া যায়নি।)
বেতারে প্রথম আবৃত্তির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ
১৯২৯ সালের ২২শে নভেম্বর, সন্ধ্যায় কাজী নজরুল ইসলাম বেতারে প্রথম আবৃত্তির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ১৯৩৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকা নাজিমুদ্দিন সড়কে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল এবং কাজী নজরুলই ঢাকা বেতার কেন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’। এই কেন্দ্রের উদ্বোধনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাণী পাঠিয়েছিলেন। পরের বছর কবি নজরুল ইসলাম আসেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। গীতি-আলেখ্যর জন্য লিখলেন গান-
‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম
আমার গানের সুর গো
আমার কথার মালা গো
কুড়িয়ে তুমি নিও।’
অল ইন্ডিয়া রেডিও
১৯৩৩ (মতান্তরে ১৯৩৬) ৮ই জুন ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ করা হয়। রবীন্দ্র প্রয়াণ দিনে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতা ‘রবিহারা’ কবির স্বকণ্ঠে প্রচারিত হয়। একই দিনে নজরুল রচিত গান ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ বেতারে প্রচারিত হয়। তাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম নিজে এবং ইলা ঘোষ। ১৯৩৪ সালে কলকাতায় বিবেকানন্দ রোডে গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান দেন। দোকানের নাম দিয়েছিলেন ‘কলগীতি’। দিনের পর দিন বাকিতে রেকর্ড দিয়ে অবশেষে এই ব্যবসা লাটে ওঠে।