পঁচিশ মার্চের সেই ছেলেটি
নাসির আহমেদ কাবুল
চারদিকে ট্যাংক আর মেশিনগানের গুলির শব্দ। মানুষের আর্তচিৎকার। শুধু আগুনের লেলিহান শিখা। দাউ দাউ করে জ্বলছে মানুষের ঘরবাড়ি। পাকিস্তানী সৈন্যদের বুলেটের আঘাতে আগুন পুড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। এসব অনেক অনেক দিন আগের কথা। ১৯৭১ সাল, ২৫ মার্চ গভীর রাতের বিভীষিকাময় ইতিহাসের কথা।
২৫ মার্চের সে রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকাসহ দেশের বড় কয়েকটি শহরে ঘুমন্ত মানুষের ওপর হঠাৎ গুলি চালাতে শুরু করে। হাজার হাজার মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে তারা। আগুন লাগিয়ে দেয় ঘরবাড়িতে। সে রাতে ঢাকা শহরেই ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যরা।
পল্লবের বয়স তখন পাঁচ। স্কুলে ভর্তি হয়েছিল পল্লব। নতুন বইখাতা নিয়ে রিকশায় চড়ে বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতো রোজ। স্কুলে যেতে খুব ভালো লাগতো ওর। কিন্তু হঠাৎ কী যে হলো! স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। ঢাকা শহর তখন মিছিলের নগরী। ছাত্র-শিক্ষক মিছিলে যাচ্ছে। অফিসের বড় সাহেব মিছিলে যাচ্ছে। কেরানী-চাপরাসি মিছিলে যাচ্ছে। এমন কি ঢাকা শহরের ঝাড়–দাররাও মিছিলে যাচ্ছে! মিছিলে সবাই গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে- ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা,’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুুজিব,’ ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো...’ইত্যাদি।
পল্লব জানালার পাশে বসে মিছিল দেখছিল। মিছিলে যাওয়ার ইচ্ছে হলো তার।
মিছিল দেখতে দেখতে পল্লব তার বাবাকে বলল, ‘বাবা আমিও মিছিলে যাবো।’
বাবা বললেন, ‘ছোটদের মিছিলে যেতে নেই।’
পল্লব বলল, ‘আমি তো বড় হয়েছি। আর কত বড় হবো বাবা?’
বাবা বললেন, ‘তুমি যখন আমার মতো বড় হবে, তখন তুমি মিছিলে যাবে।’
পল্লব বলল, ‘তখনও কি মিছিল থাকবে?’
বাবা পল্লবের কথার উত্তর দিতে পারলেন না।
পল্লব বাবাকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘তুমি কথা বলছো না কেন, তখনও কি মিছিল থাকবে?’
বাবা বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হলে মিছিল থাকবে না। তখন আর আমরা কার বিরুদ্ধে মিছিল করবো?’
‘বাবা স্বাধীন হওয়া কি?’ পল্লব ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করলো।
বাবা বললেন, ‘নিজের ইচ্ছে মতো চলা, নিজের মতো কথা বলা।’
পল্লব বলল, ‘আমরা তো ইচ্ছে মতো চলছি।’
বাবা বললেন, ‘না আমরা ইচ্ছে মতো চলতে পারছি না। ইচ্ছে মতো কথা বলতে পারছি না। পাকিস্তানীরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে দিতে চায়নি। আমরা ১৯৫২ সালে মিছিল করেছি বাংলায় কথা বলার জন্য। মিছিল করতে গিয়ে সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তানীরা আমাদের দেশের সব সম্পদ লুটপাট করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কলকারখানা হচ্ছে- সেখানে শুধু ওদেরই চাকরি হয়। অথচ আমরা বাঙালিরা লেখাপড়া শিখেও চাকরি পাচ্ছি না। না খেয়ে থাকছে মানুষ। আমরা আমাদের ইচ্ছে মতো কিছুই করতে পারছি না, এটাকে বলে পরাধীনতা। এ থেকে আমরা মুক্তি চাচ্ছি। সেই মুক্তির নামই স্বাধীনতা।
পল্লব হঠাৎ বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা শেখ মুজিব কে? ওরা কি তাকে আটকে রেখেছে?’
বাবা বললেন, ‘শেখ মুজিব আমাদের নেতা। আমরা তার কথায় দেশের সব কলকারখানা, অফিস-আদালত বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা পাকিস্তানীদের কোন রকম সাহায্য-সহযোগিতা করছি না। এটাকে অসহযোগ আন্দোলন বলে। যে পর্যন্ত না পাকিস্তানীরা আমাদের নেতা শেখ মুজিবকে দেশ চালানোর ক্ষমতা দেয় সে পর্যন্ত আমরা অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেদিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ছিলো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত। পল্লব ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। ঘুমিয়ে পারেননি কলেজ শিক্ষক সাব্বির সাহেব। হঠাৎ রাতের নিস্তবদ্ধতা ভেঙ্গে চারদিকে গুলির শব্দে আতঙ্কিত হলেন তিনি।
শান্তিনগরের পাশে বাড়ির তিন তলা থেকে সাব্বির সাহেব দেখলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে অনেকগুলো ট্যাংক গুলি করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে পেলেন তিনি। জানালা বন্ধ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো পল্লবের। ওর মা নেই, জন্মের মাত্র দু’ বছরের মাথায় লঞ্চডুবিতে মারা গেছেন ওর মা। তারপর এই তিনটি বছর বাবা একলাই আগলিয়ে রেখেছিলেন পল্লবকে। কলেজে যাওয়ার সময় পল্লবকে পাশের ফ্লাটে রেখে যান। আবার কলেজ থেকে ফিরে নিজের কাছে আনেন।
‘বাবা কিসের শব্দ?’ পল্লব আতঙ্কিত হয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো।
সাব্বির সাহেব ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ওরা গুলি করে মারছে আমাদের।’
পল্লব আরও ভয় পেলো। বলল, ‘ওরা কারা বাবা?’
বাবা বললেন, ‘ওরা পাকিস্তানী। হানাদার ওরা। হায়েনার দল ওরা...ওরা আমাদের শত্রু।’
পল্লব বাবার বুকের মধ্যে সেঁটে গিয়ে বলল, ‘ওরা যদি তোমাকে মেরে ফেলে?’
পল্লবের কথা শেষ না হতেই দরজায় ভারি বুকের শব্দ পেলেন সাব্বির সাহেব। তিনি তাড়াতাড়ি পল্লবকে খাটের নীচে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওখানে চুপ করে বসে থাকো।’
কয়েক মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েক রাউন্ড গুলি চালালো ওরা সাব্বির সাহেবকে লক্ষ্য করে। সাব্বির সাহেব লুটিয়ে পড়লেন।
পল্লব খাটের নীচে বসে বাবার করুণ মৃত্যু দেখলো। ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো সে। এসব দেখে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেছে পল্লব! সকাল হলো। চারদিকে সূর্যের আলো জ্বলে উঠলো। পল্লব বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বাবা বাবা বলে ডাকলো বার বার। বাবা পল্লবের ডাকে সাড়া দিলেন না। কী করে সাড়া দেবেন! মৃত মানুষ কি আর কথা বলতে পারে!
কেউ নেই কাছাকাছি। অনেককেই গুলি করে মেরেছে পাকিস্তানীরা। অনেক আবার পালিয়ে গেছে। পল্লবকে সান্ত¦না দেয়ার জন্যও কেউ এগিয়ে এলো না। এক সময় প্রচন্ড ক্ষুধা পেলো পল্লবের। রাস্তায় বের হলো সে। কোন খাবার দোকানও খোলা নেই। একটা ডাস্টবিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো পল্লব। তারপর ডাস্টবিন থেকে পচা খাবার খেতে লাগলো কাক ও কুকুরেরর সঙ্গে।
পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা। দীর্ঘ ন’মাস যুদ্ধ চলল। যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলো। এই নয় মাসে পল্লব ফুটপাতে ঘুমাতো। কুকুর ও বিড়ালের সঙ্গে ডাস্টবিনের খাবার ভাগাভাগি করে খেতো। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য রেসকোর্স ময়দানে (এখনকার সোহরাওয়াদী উদ্যান) মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো। স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। পল্লব তখন কিছুটা বড় হয়েছে। এক গরীব রিকশাচালক পল্লবকে একা দেখে নিজের কাছে নিয়ে গেলো। সেখানে দিনে দিনে বড় হতে লাগলো পল্লব।
পল্লবের বয়স এখন ছেচল্লিশ বছর। এই শহরের রিকশাওয়ালাদের একজন সে। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে রিকশায় ছোট জাতীয় পতাকা ওড়ায় পল্লব। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যায়। সেখানে বেদিতে ফুল ছিটিয়ে দিয়ে কাঁদে আর বলে- ‘বাবা, দেখে যাও আমরা আজ স্বাধীন। এখন আর কেউ আমাদের শোষণ করে না। আর যারা স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানীদের সহায়তা করেছিল, আমাদের হত্যা করেছিল সেসব রাজাকার ও আলবদরদের বিচার চলছে- তারা আজ বন্দী।’
নাসির আহমেদ কাবুল
৩ এপ্রিল, ২০১২