অরুণোদয়ের পথে
একাত্তরের মধ্য শ্রাবণের এক গভীর রাত। আকাশে চাঁদ ছিল সে রাতে। তবে মেঘে ঢাকা পড়েছিল জ্যোৎ¯œার প্লাবন। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টিতে মেঘের আস্তর কিছুটা হালকা হলে চাঁদের ম্লান-মূক আলো ছড়িয়ে পড়ছিল গ্রামের পথে। যে পথ ধরে কয়েকজন পিশাচ টর্চের তীব্র আলো ফেলে পথ চলছিল দানবের মতো। ওদের সবার হাতে রাইফেল, উন্মুক্ত বেয়নেট। ওদের পায়ের শব্দে ঝিঁঝিঁপোকা আর ব্যাঙগুলোর ডাকাডাকি থেমে গেলো আতঙ্কে। নিস্তব্ধ ভূতুরে সে পরিবেশে রাজাকাররা অশ্লীল গালাগাল দিচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরÑযাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার জন্যে মরণপণ লড়াইয়ে মেতে উঠেছে।
ভূতুরে অন্ধকার সে রাতে কয়েকজন রাজাকার হালদার বাড়ির দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াল। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে পরলেও নিশিকান্ত হালদার জেগেছিলেন। সন্ধ্যায় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে কালুরঘাট ব্রিজের পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর শুনেছেন। এম আর আক্তার মুকুলের কণ্ঠে চরমপত্র শুনে অনেকটা উৎফুল্লও তিনি। নিশিকান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দু-একদিনের মধ্যেই ছেলে শিবুকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাঠাবেন। এসব উত্তেজনার মধ্যে ঘুম আসছিল না তার। হঠাৎ ভারি বুটের শব্দে সচকিত হলেন তিনি।
‘এই নিশিকান্ত, দরজা খোল’।
নিশিকান্তের ফ্যাঁসফেসে গলা থেকে বেরিয়ে এলো, ‘কে?’
রাজাকার কমান্ডার সুফি ধমকে উঠলো ‘তোর বাপ, শুয়োরের বাচ্চা।’
নিশিকান্ত সুফির কণ্ঠ চিনতে পারলেন। দ্রুত শিবুকে মোটা পাতার হোগলার মুড়ে ঘরের এক কোণে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মেয়ে সুবর্ণাকে তোষকে পেঁচিয়ে খাটের এক প্রান্তে সরিয়ে রাখলেন। তারপর নিশিকান্ত ও তার স্ত্রী বলির পাঠার মতো কাঁপতে লাগলেন।
রাজাকারদের রাইফেলের বাঁটের আঘাত ও লাথিতে কাঠের দরজা ভেঙ্গে ছিটকে পড়লো। ঘরে ঢুকে নিশিকান্তের স্ত্রী রমলাকে নিশিকান্তের সঙ্গে পিঠেপিঠি বেঁধে ফেলল রাজাকাররা।
রহমান রাজাকার হুংকার দিয়ে বলল, ‘এই শুয়োরের বাচ্চা শিবু কই?’
‘ও তো বাড়িতে নেই স্যার।’
একজন রাজাকার রাইফেলের বাট দিয়ে নিশিকান্তের পেটে আঘাত করলো।
‘বল শুয়োরের বাচ্চা শিবু কোথায়?’ আবারও হুংকার দিলো রহমান।
‘সত্যিই জানি না। বিকেলে বের হয়েছে, রাতে আর ফিরে আসেনি?’
‘মুক্তিবাহিনীতে গেছে?’
‘না, না মুক্তিবাহিনীতে যায়নি।’
‘মিথ্যে বলছিস।’
‘ভগবানের দোহাই...।’
রাজাকাররা নিশিকান্তকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেলো। কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
কমান্ডার সুফি নিশিকান্তের বুকে রাইফেল তাক করে বলল, ‘বল, শিবু কোথায়?’
‘বলছি তো, জানি না।’
‘শিবু কোথায় বল, নইলে কুত্তার মতো গুলি করে মারবো।’
‘ভগবানের দোহাই, আমাকে মারবেন না।’
‘তাহলে বল, শিবু কোথায়?’
নিশিকান্তে দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। পরক্ষণেই শক্ত হলেন তিনি। প্রাণ গেলেও কিছুতেই শিবুর খোঁজ দেবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। নিশিকান্ত ভাবলো, ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে শিবুর মতো ছেলেদের বেঁচে থাকতে হবে।
‘কিরে বলছিস না কেন? না বললে গুলি করে মারবো।’ কমান্ডার হুংকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘তাই করুন। তবু শিবু কোথায় বলতে পারবো না।’
‘পারবি না?
‘না।’
হঠাৎ নিশিকান্ত কণ্ঠে এতো জোর কোথায় পেলেন ভাবতে পারলেন নিজেই।
রাজাকার ফরিদ আর সুযোগ দিলো না। নিশিকান্তের তলপেটে প্রচন্ড জোড়ে লাথি মারলো। লুটিয়ে পড়লো নিশিকান্ত। একটা গোঙানি দিয়ে স্থির হয়ে গেলো নিশিকান্তের দেহ।
রাজাকাররা সুবর্ণার কথা জিজ্ঞেস করলে কিছুতেই মুখ খুললেন না রমলা।
রমলার চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টানে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বুট জুতো দিয়ে গলা চেপে ধরলো রহমান রাজাকার। মুখ দিয়ে ফেনা বের হলো রমলার। রাজাকার রহমান হুংকার দিয়ে বলল, ‘বল, সুবর্ণা কোথায়?’
‘বাড়িতে নেই।’
‘কোথায়?’
‘ওর মাসীর বাড়ি।’
‘মিথ্যে কথা। বিকেলেও দেখেছি ওকে।’
‘মিথ্যে বলছি না।’
কথা বের করতে না পেরে বুট জুতো দিয়ে রমলার তলপেটে আঘাত করলো রাজাকার সুফি। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো রমলা। তবুও সুবর্ণার কথা জানালো না সে।
রাজাকাররা টর্চের আলো ফেলে সারাঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলো সুবর্ণাকে।
তোষকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুবর্ণা ভয়ে কাঁপতে লাগলো।
হঠাৎ রহমান রাজাকারের দৃষ্টি গেলো মোড়ানো তোষকের দিকে। তোষকের ভাঁজ খুলে সুবর্ণাকে পেলো তারা। উল্লাসে ফেটে পড়লো রাজাকাররা।
কোন আকুতি শুনলো না পিশাচরা। মায়ের সামনে বিবস্ত্রা করলো সুবর্ণাকে। তারপর একে একে পাঁচজনে ধর্ষণ করলো ষোল বছরের কিশোরীকে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সুবর্ণা।
মা দুই হাতে চোখ ঢাকলেন। মনে মনে বললেন, ‘ভগবান মৃত্যু দাও, মৃত্যু দাও ভগবান!’
শিবু চোখে দেখলো না, তবে বাইরের সব কথাই তার কানে আসছিল। মায়ের আকুতি, বোনের আর্তনাদে পাথর হয়ে গেলো শিবু। একবার মনে করলো বের হয়ে এসে রাজাকারদের মুখোমুখি দাঁড়াবে সে। একা পাঁচজন রাজাকারের সঙ্গে পেরে উঠবে না ভেবে চোখ বুজে সবকিছু সহ্য করলো সে।
নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করতে করতে রাজাকাররা চলে গেলে কিছুক্ষণ পর শিবু বের হয়ে এলো। মা রমলা শিবুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর সুবর্ণা তার মাকে জড়িয়ে ধরে থর থর করে কাঁদতে লাগলো। রমলা অনেকক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে থাকলো সুবর্ণার দিকে। একদিকে স্বামীর লাশ অন্যদিকে মেয়ের দুর্দশায় হতবিহ্বল রমলা ছেলে শিবুকে বললেন, ‘তোর বাবার শেষকৃত্য হবে না?’
‘হবে মা।’
শিবু সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে ধীরে ধীরে বাবার লাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হাঁটু গেড়ে বসে বাবার লাশ স্পর্শ করে বলল, ‘তোমাকে যারা হত্যা করেছে, তার প্রতিশোধ আমি নেবোই, তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো বাবা।’
সুবর্ণা এসে শিবুর পাশে দাঁড়ালো। ছোট বোনকে আদর করে বুকের মধ্যে টেনে নিলো শিবু। সাহস দিয়ে বলল, ‘ভয় নেই, বাবার লাশের একটা ব্যবস্থা করে আমরা রাতেই পালিয়ে যাবো।’
মা বললেন, ‘কোথায়?’
শিবু বলল, ‘ভারতে।’
তোরা ভাই-বোন দু’জনে যা, আমি তোর বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না।
সেকি মা! তুমি এখানে থাকলে কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।
ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে স্বামীর লাশ জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর কেঁদে ফেললেন রমলা। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তোমাকে ছেড়ে কিছুতেই প্রাণ ভয়ে পালাতে পারবো না আমি। আমি তোমার সাথেই থাকবো।’
দাহ হলো না নিশিকান্তের। সে রাতে কোঁদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে বাবার লাশ শুইয়ে দিলো শিবু। তারপর মাকে বলল, ‘চলো মা, আমরা পালিয়ে যাই।’
‘না, আমি যাবো না। তোরা যা। তোর বাবাকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে পারবো না আমি।’
শিবু অনেক বোঝালো, লাভ হলো না। রমলাকে কিছুতেই তার সিদ্ধান্ত থেকে বদলানো গেলো না।
দেখতে দেখতে পূর্ব দিগন্ত লাল হয়ে উঠলো। গাছে গাছে পাখি ডেকে উঠে জানান দিলো, ভোর হয়ে এসেছে। অথচ শিবু কিছুতেই তার মাকে বোঝাতে পারছে না!
এরই মধ্যে রহমান রাজাকার আবার ফিরে এলো শিবুদের বাড়ি। শিবু দৌড়ে ঝোঁপের আড়ালে পালালো। পালাতে পারলো না সুবর্ণা। রাজাকার রহমান এসে সুবর্ণার হাত ধরলো। টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইলো সুবর্ণাকো। মা এসে রাজাকারদের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন।
রহমান বলল, ‘সরে যা বলছি।’
মা মিনতি করে বললেন, ‘আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। দয়া করো।’
আড়াল থেকে সবই দেখলো শিবু। হাতের কাছে শুকনো একটি ডাল পেয়ে গেলো সে। হঠাৎ পিছন থেকে এসে রহমান রাজাকারের মাথায় আঘাত করলো শিবু। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো রহমান। শিবু রহমানের হাত থেকে রাইফেলটা তুলে নিলো। পর পর দুটো গুলি করলো রহমান রাজাকারের বুকে।
কাঁধে রাইফেল আর ডান হাতে সুবর্ণা ও বাম হাতে মাকে নিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলো শিবু। সকালের তোজোদীপ্ত সূর্যের আলোয় দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা উদ্ভাসিত হলো শিবু। এগিয়ে চললো সে সূর্যের পথ ধরে।
০৬ নভেম্বর, ২০১১
শেষ