শিশু শ্রম রোধ করতে চাই সামাজিক সচেতনতা
দশ বছরের শিশু হানিফ মোটর মেকানিক্সের কাজ করে। সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত রাস্তার পাশে রোদে পুরে, শীতে কষ্ট করে ধূলাবালি ও মারাত্মক শব্দ দূষণের মধ্যে হানিফকে কাজ করতে হয়। এ সময়ের মধ্যে দুপুরে মিনিট দশেকের মতো সময় পায় সে দুপুরের খাবারের জন্য। এ ছাড়া আর কোন ফুরসৎ নেই তার। অনেক সময় মালিকের গালমন্দ ছাড়াও শারীরিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয় তাকে। বছরে দুই ঈদ ছাড়া আর কোন ছুটি নেই তার। সরকারী ছুটির দিনেও অতিরিক্ত মজুরি ছাড়াই কাজ করতে হয় তাকে। কিছুদিন আগেও সাপ্তাহিক ছুটি বলতে কিছুই ছিলো না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে মার্কেটগুলোর সাপ্তাহিক ছুটি বাধ্যতামূলক করায় হানিফের ছুটি মিলেছেÑ সপ্তাহে একদিন ছুটি পায় হানিফ।
হানিফের ভাষায় ‘ছুটির দিনটা খুব মজা করি স্যার। সাইকেল চালাই, ভিডিও গেইম খেলি। মায়েরে সাহায্য করি। আরও কতো কি...।’ ‘আরো কতো কি’ বলার মধ্যে হানিফের ছুটির আনন্দেও উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেছে। হানিফের মাসিক বেতন ৮শ’ টাক। এ দিয়ে মা ও ছেলের সংসার চলে না। সংসারের প্রয়োজনে হানিফের মা রাস্তার পাশে শাক-সবজি বিক্রি করে। বাস্তির একটি ঘরে মাসে ৫শ’ টাকা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের। হানিফ কেন লেখাপড়া শিখছে নাÑএ প্রশ্নে উত্তরে হানিফের মা বললেন, ‘ছেলেরে স্কুলে পাঠাইলে খামু কি, না খাইয়া থাকতে হইবো আমাগো।’
ইউনিসেফ জানায়, বাংলাদেশে ৩৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩ কোটি ৩০ লাখ শিশু দারিদ্র্যতার মধ্যে বাস করে। বেসরকারী একটি সংস্থার জরিপে জানা যায়, শিশুদের এই হার দেশের মোট শিশুদের ৪৫ শতাংশ। এদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ শিশুই দারিদ্যসীমার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ শিশু ছিন্নমূল। এসব ছিন্নমূল শিশু ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে বাস করে। জীবিকার তাগিদে এরা কাজ করতে বাধ্য হয়। ছিন্নমূল শিশুদের সর্বোচ্চ সংখ্যা অর্থাৎ ৬৩ দশমিক ৯০ শতাংশ বাস করে ঢাকায়। সর্বনিম্ন বরিশালে শতকরা ২ দশমিক ৫ ভাগ।
শহরে যেসব শিশু বাস করতে বাধ্য হয় তাদের শতকরা ৪৬ ভাগ দারিদ্র্যের কারণে, ১৬ ভাগ আশ্রয়ের অভাবে ও ১৮ ভাগ বাবা-মা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসায় শিশুরা তাদের সঙ্গে শহরে আসতে বাধ্য হয়েছে।
শিশু অধিকার ফোরাম জানায়, পথশিশুদের শতকরা ৫৩ ভাগ ছেলে ও ৪৭ ভাগ মেয়ে শিশু। প্রায় ৪৯ ভাগ শিশু রাস্তার পাশে বাস করতে বাধ্য হয়। এদের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে শিশুদের হার শতকরা ৪৩ ভাগ। এদের মধ্যে শতকরা ৩১ ভাগ কোন লেখাপড়া জানে না। ৩৭ ভাগ লিখতে ও পড়তে পারে। এদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ শিশুর প্রথম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণীতে পড়ার সুযোগ হয়েছে।
এসব শিশুদেও অনেকের বাবা-মা নেই। অনেক শিশু জানেই না যে তাদের বাবা-মা কে অথবা কোথায় আছে। অনেক শিশু আছে যাদের বাবা-থাকলেও তারা এদের খোঁজ খবর রাখে না, অথবা রাখতে সক্ষম নয়।
অভিভাবকহীন এসব শিশুরা জীবনধারনের জন্য বাধ্য হয় অর্থ উপার্জনের কোন না কোন পেশা বেছে নিতে। এরা ভাঙ্গারীর ব্যবসা, ট্রাফিক সিগন্যালে ফুল বিক্রি, হোটেল রেস্তোরাঁর কাজ ও ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। এদের মধ্যে অনেকে আবার চুরি করে আয় রোজগারের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। শিশুদের একটি অংশ যৌন পেশা ও মাদক বিক্রি করে রোজগারে উৎসাহ বোধ করে।
বাংলাদেশে আইএলও’র পরিচালক আন্দ্রে বোগি বলেন, ৪৫ শতাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। আইএলও’র একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিশুরা অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, অ্যালুমিনিয়াম, আগরবাতি, বেলুন, ব্যাটারী, রিরোলিং, আসবাবপত্র কারখানা, মোটর গ্যারেজ, গ্যাস বার্নার মেরামত, বই বাঁধাই, বৈদ্যুতিকত কাজ, গাড়ি ও ফার্টিচার রং করা, বাতি তৈরি ও লোহা কাটার কাজ করছে।
১৯৫৯ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। এই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপধারা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করা চলবে না। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন : শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর বিকাশের পরিবেশ এবং অধিকার দিতে হবে। পিতা-মাতার পরিচয়বিহীন শিশুকে রাষ্ট্র লালন করবে। শিশুদের মারধর ও অত্যাচার করা যাবে না। যৌনাচারে ব্যবহার করা যাবে না। পঙ্গু শিশুকে পরিপূর্ণ সামাজিক সুন্দর পরিবেশে জীবনযাপনের মর্যাদা দিতে হবে। শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। শিশুদের আর্থিক সুবিধা দিতে হবে। শিশুদের অপরাধ জগতে প্রবেশের পথ রুদ্ধ করতে হবে।
শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বিভিন্নমুখি পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফ, আইএলও এবং বিজিএমইএ পোশাক শিল্পে শিশু শ্রম নিরোধে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা সনদ সম্পাদন করেছে; যেখানে গার্মেন্টস শিল্প থেকে শিশুশ্রম দূর করার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার শিশুদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের উদ্যোগে এবং বেসরকারী সংস্থা নারী ও শিশু উন্নয়নে কাজ করছে। সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী ও শিশু উন্নয়নে সবাইকে সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণাসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
এসব শিশুকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেশের কাক্সিক্ষত উন্নতি কখনো সম্ভব নয়। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে এসব শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রথমেই এদের চিহ্নিত করতে হবে। প্রতিটি শহরে শিশু আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তুলে শিশুদের বসবাসের সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে স্কুল ও কারিগরি শিক্ষা নিকেতন গড়ে তুলে এসব শিশুদের শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীতে পরিণত করতে হবে। এ জন্যে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। তাছাড়া বেসরকারী সংস্থা ও মহৎ ব্যক্তিদের উদ্যোগ পাওয়া গেলে শিশুদের এ অমানবিক সমস্যা সমাধান খুব একটা কঠিন হবে না।
কর্মজীবী এসব শিশু শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। এই শিশুরা উৎপাদনশীল খাতে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমেও শিশুদের ক্ষমতায়নের চেষ্টা করা যেতে পারে। এর ফলে শহর ও গ্রামাঞ্চলের পাঁচ থেকে আঠারো বছর বয়সী সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এবং আঠার থেকে বাইশ বছর বয়সী যুবকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পালে। শিশুদের সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারলে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হবে। এ জন্যে সবার দরকার সকলের মধ্যেই সচেতনতা। শিশু, তার পিতা-মাতা ও সমাজের সবাই শিশু শ্রমের ক্ষতিকর দিক ও সুন্দও ভবিষ্যত বিনির্মাণের বিষয়ে সতর্ক হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শিশু বন্ধ করা সম্ভব হবে।