সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে গ্রিন হাউস ইফেক্ট থেকে বাঁচতে পারে বাংলাদেশ

ধীরে ধীরে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পৃথিবী। এর জন্য মূলত বর্তমান সভ্যতাই দায়ী। আধুনিকতা তথা যান্ত্রিকতার কারণে কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে  গিয়ে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ফলে গোটা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক দিক লক্ষ করা গেছে। ইতিমধ্যেই আন্টার্টিকা মহাদেশ ও হিমালয়ের লাখ লাখ বছরের পুরানো বরফ খণ্ড গলতে শুরু করেছে। এই গলা অব্যাহত থাকলে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে এক মিটার। এতে সমুদ্র উপকূলবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অনেকগুলো দেশ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আশার বাণী শোনা যাচ্ছে। আর তা হলো সমুদ্রের পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বাংলাদেশ এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে একবিংশ শতাব্দিতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১.৮ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশ্বের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা উষ্ণতা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিজ্ঞানীদের অভিমত, আগামী ৯০ বছরের মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড, তিব্বত ও হিমালয়ের হিমবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ গলে যাবে।  তাঁরা আশঙ্কা করছেন সাগরের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি বাড়লে পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার সব বরফ গলে যাবে এবং সাগরের উচ্চতা বাড়বে ৫ মির্টার। বর্তমানে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ১ মিটার। 

জলবায়ুর এই পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সিডর’র আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে সুন্দরবনসহ গোটা উপকূলীয় এলাকায়। পরবর্তীতে নার্গিস নামের আরো একটি ঝড়েও ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। সিডর বিধ্বস্ত এলাকায় লবণাক্ত পানির প্রভাব ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কমছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ সেন্টিমিটার বাড়লে খাদ্য উৎপাদন ৮০ শতাংশ কমে যাবে। তখন বিশাল এই জনসংখ্যার দেশে না খেয়ে মারা যাবে হাজার হাজার মানুষ। বর্তমানে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে এক মিটার বাড়বে তাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, মালদ্বীপ ও কিরিবাতি সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বাস্তুহারা হবে ৮ থেকে ১০ কোটি মানুষ।

সম্প্রতি ১৭০টি দেশের পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, সমুদ্রপেৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দক্ষিণ এশিয়া জলবায়ুর ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। আগামী ৩০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝূঁকিপূর্ণ ১৬টি দেশের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে বাংলাদেশের নাম। ভারত দ্বিতীয় স্থানে। নেপাল তৃতীয় ও আফগানিস্তান অষ্টম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৬ নম্বরে। ব্রিটেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্রফট এই জরিপ চালায়।

২০০৫ সালে জানুয়ারিতে নাসার বিজ্ঞানীরা দেখতে পায়, পশ্চিম আন্টারটিকা মহাদেশে ভয়াবহ হারে বরফ গলছে। জাতিসংঘের জলবায়ু গবেষকদের ধারণা, ২১ শতকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়বে। এই ফলে পশ্চিম আন্টারটিকা ও গ্রীনল্যান্ডের অধিকাংশ হিমবাহ গলে যাবে। সব মিলিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বাড়বে প্রায় ১২ মিটার।

মার্কিট ভূতত্ত্ব জরিপ (ইউএসজিএস)-এর রিপোর্টে বলা হয়, তিব্বত ও হিমালয়ে প্রায় ৩৭ হাজার হিমবাহ (বিশাল বরফ খণ্ড) রয়েছে। যার মধ্যে কিছু কিছু প্রায় ৭ লাখ বছরের  পুরানো। এগুলো এখন দ্রুতহারে গলছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, তাপমাত্রা না কমালে ২০৫০ সাল নাগাদ সব হিমবাহ গলে শেষ হয়ে যাবে।

ইউএসজিএস-এর গবেষণায় বলা হয়, পৃথিবীতে মোট পানির পরিমাণ ১শ’ ৩৮ কোটি ৩৭ হাজার ঘন কিলোমিটার। এর শতকরা ৯৭ ভাগ পানির আধার সাগর ও মহাসাগর। এর সঙ্গে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে বরফ গলা পানি, যা সরাসরি সাগরে অথবা নদ-নদী দিয়ে সাগরে মিশছে। বছরে বরফ গলা পানির পরিমাণ ১২ থেকে ১৬ হাজার ঘন কিলেমিটার।

ম্যাপলক্রাফট জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়া বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ এ বছর পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বন্যায় দুই কোটি লোক  ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাপমাত্রা খুব সামান্য পরিবর্তন পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এতে পানির সহজলভ্যতা ও ফসল উৎপাদনের পরিবর্তন ঘটায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূমির পরিমাণ হ্রাস পায়। পৃথিবীর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৪ কোটি ১৪ লাখ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র ২৭ লাখ বর্গকিলোমিটার জমি সেচের আওতায় আনা হয়েছে। পানির অভাবে বাকি জমি সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

উইডো ফাউন্ডেশন সব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছে। ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মীর মনিরুজ্জামান তার গবেষণায় বলেন, ‘সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি কমিয়ে রাখা গেলে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ বা দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হবে না।’ কার্বন নির্গমন কমানোর বিকল্প হিসেবে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব বলে উইডো ফাউন্ডেশন মনে করে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রতিবছর ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার ঘন কিলোমিটার সমুদ্রের পানি ব্যবহার করলেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে তারা এ কথাও বলছে যে, প্রক্রিয়াটি সহজ হলেও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে অসম্ভব নয়। 

মীর মনিরুজ্জামানের গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, পৃথিবীর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৪ কোটি ১৪ লাখ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র ২৭ লাখ বগকিলোমিটার জমি সেচের আওতায় নেয়া হয়েছে। কেবল পানির অভাবে বাকি জমি সেচ সুবিধা দেয়া যায় না। সমুদ্রের পানি পরিশোধন করে আরো ৩০ লাখ বর্গ কিলোমিটার জমি সেচের আওতায় আনা গেলে বছরে অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হবে প্রায় ৮ হাজার ঘন কিলোমিটার। প্রতিবছর সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পায় ১২ থেকে ১৬ হাজার ঘন কিলোমিটার। আফ্রিকার সাব-সাহারান এলাকায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ বর্গ কিলোমিটার। এ জমির মাত্র ১৫ লাখ ৭৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার সেচ সুবিধা দেয়া হয়। আফ্রিকার আবাদযোগ্য জমির অর্ধেক সেচ সুবিধা দিয়ে কৃষিকাজ করলে কয়েক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। আফ্রিকা থেকে দুর্ভিক্ষ পালাবে এবং হাজার বছরেও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে না এবং আফ্রিকায় খাদ্য ও পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দেবে না। 

সমুদ্রের পানি পরিশোধন ব্যয় একটু বেশি। প্রতি ঘনমিটার পানি পরিশোধনে সিঙ্গাপুরে খরচ হয় ৪৯ সেন্ট, ইসরাইলে ৫৩ সেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রে ৮১ সেন্ট। তবে প্রযুক্তির উন্নয়ন হলে এ খরচ আরো কমবে। আর সমুদ্রের পরিশোধিত পানি দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে পরিশোধন ব্যয় শূন্যের কোটায় নেবে আসবে। সৌদি আরবের বেশ কিছু শোধনাগার রয়েছে। এক একটি বড় শোধনাগার স্থাপনে খরচ হয় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সমুদ্রের পানি শোধনাগার স্থাপনের কাজ চলছে। এ অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে ৩০ হাজার শোধনাগার নির্মাণে খরচ হবে প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ডলার।  

চীন ও ইসরাইল ইতিমধ্যে সমুদ্রের পানি দিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেছে। চীনের ডংজিং বিনজু প্রদেশে সর্বপ্রথম সমুদ্রের পানি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়। এরপর তা অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। চীনে এখন সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লাখ লাখ টন খাদ্য শস্য উৎপাদন করা হচ্ছে। ইসরাইলে সমুদ্রের পানি পরিশোধন করে তা মরুভূমিতে সেচকাজে ব্যবহার করে সবুজ ইসরাইল গড়ে তোলা হয়েছে। বাতাসে কার্বণ নির্গমণ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি সমুদ্রের পানির সর্বাধিক ব্যবহার করে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। পৃথিবীর বুদ্ধিমান সচেতন মানুষ অবশ্যই তা করবে নিজেদের প্রয়োজনেই।


নাসির আহমেদ কাবুল
ই-মেইল :
jalchhabi2015@gmail.com
ফোন : ০১৮১৭১২৭৮০৭, ০১৯১৫৬৮৪৪৩৪, ৯১৩৭০৮৭


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url