তৃতীয় পক্ষ [পর্ব ৪]
॥ চার ॥
রিকশা থেকে নেমে সজল দেখল চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। হয়ত নিয়মিত লোডশেডিং চলছে। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে মোমবাতি ও চার্জার লাইট জ্বলছে। অন্ধকারে অন্যমনষ্ক হাঁটতে হাঁটতে পথচারীদের দু’একজনের সঙ্গে সজলের ধাক্কা লাগল। ‘সরি’ বলে ভদ্রতা বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সে।
মামুনদের বাসাটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না সজল। কতবার সে মামুনদের বাসায় এসেছে, অথচ আজ কেন জানি পথটা বড় অচেনা লাগছিল তার কাছে। গলিটা ঠিকই আছে, কিন্তু বারো বাই তেইশ লেক সার্কাসের ছোট্ট দোতালা বাড়িটা কিছুতেই খুঁজে পাছিল না সে। হতাশ হয়ে একটা লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়াল সে। পাশেই একজন দোকানীকে নাম্বারটা বলতেই লোকটি বলল, ‘মামুন ভাইয়ের বাসা?’
‘জ্বি।’
এই তো একটু আগে মামুন ভাই মোম বাতি কিনে নিয়ে গেলেন। ওই যে বাঁ-দিকের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটাই মামুন ভাইদের বাসা।
‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। আপনাকে ধন্যবাদ।’
সজল এবার ঠিক ঠিক মামুনদের বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। কাঠের দরজায় আস্তে আস্তে আঙুল দিয়ে টোকা দিতেই মামুনের কন্ঠ শুনতে পেল সজল।
‘কে?’
‘আমি সজল।’
দরজা খুলে দিল মামুন। মামুনের চোখে কালো ফ্রেমের পুরু লেন্সের চশমা। চশমা ছাড়া এক পাও চলতে পারে না সে। তাছাড়া অনেকটা রাতকানা রোগে আক্রান্ত মামুন।
মামুন সজলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। বছরখানেক আগে ফাইন আর্টসে মাস্টার্স করে বেকার জীবন কাটাচ্ছে এখন। একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছে সে; হয়নি।
মামুনের বাবা আতোয়ার সাহেব আদালতপাড়ায় খুবই জনপ্রিয় এবং ডাকসাঁইটে উকিল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বছর দুয়েক আগে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এই বাড়িটা ছাড়া তেমন আর কিছুই রেখে যেতে পারেননি তিনি। মামুনের মা খুবই হিসেবী মহিলা। নিজেরা নীচতলায় থেকে দোতলার চারটি রুম ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকা ও স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসার চালান তিনি। এ ছাড়া অন্য কোন অবলম্বন নেই তার।
মামুনের ছোট বোন বীথি এবার ইডেনে ইকোনোমিকসে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। সজলের প্রতি বীথির একটা-আধটু দুর্বলতা আছে। সজল বুঝতে পারলেও ধরা দেয়নি কখনও। এ জন্যেই অনেকটা এড়িয়ে চলতে চায় সজল। আগের মতো খুব একটা আসে না সে মামুনদের বাসায়।
দুপুরে স্বাতীর সঙ্গে সজলের অনেক দিনের পুরনো ইচ্ছেটা জানাজানি হওয়ার পর এবং স্বাতীর বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনে সজল নিজেকে খুব অসহায় ভাবতে শুরু করেছে। দিকভ্রান্ত নাবিকের মত একটা অবলম্বন খুঁজতে খুঁজতে মামুনের কথাই বেশি করে মনে পড়েছে সজলের। বিষয়টা নিয়ে একটু-আধটু আলোচনার জন্যই সে এতো কষ্ট করে মামুনদের বাসাটা খুঁজে বের করেছে।
সজলকে দেখে মামুন বলল, ‘আয় সজল।’
সজল সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘এক গ্লাস ঠা-া পানি দিবি?’
‘মানে? এমন করে বলছিস কেন?’
‘সরি।’
মামুন ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠা-া পানি ও একটি গ্লাস নিয়ে আসে। অন্ধকারে গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে ছলকে কিছুটা পানি মেঝের ওপর পড়ে যায়। সজল মামুনের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে খালি গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে দেয়।
‘কী হয়েছে তোর?’
‘কিছু তো একটা হয়েছে। না হলে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে তোর এখানে আসা কেন?’ ম্লান হেসে সজল বলল।
মামুন অবাক হয়ে বলে, ‘বুঝলাম না তো!’
‘আরে বাবা কিছুতেই তোদের বাসাটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
‘কী বলছিস তুই!’
‘যা বলছি, সবই সত্যি। শেষে একজন দোকানীকে জিজ্ঞেস করায় সে বলে দিয়েছে।’
‘তুই তো বেশ কয়েকবার এসেছিস?’
‘কী জানি। মাথাটা কাজ করছিল না।’
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে আসায় মামুন মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। বিদ্যুতের আলোয় সজলকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে চমকে উঠল।
‘একি হয়েছে তোর! জ্বরটর হয়নি তো?’
সজলের পাশে বসে কপালে হাত দেয় মামুন।
‘না না জ্বর হবে কেন? অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম।’
‘হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজার সখ হল কেন?’
‘এত জেরা করছিস কেন?’
‘করব না!’
‘না। জেরা করার মতো কিছুই হয়নি। তবে...’
‘তবে কি?’
ছোটবেলা থেকেই দুঃখ-কষ্ট, অভাব আর অনটনের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছে মামুন। বাবা ওকালতি করে মক্কেলদের মামলা জিতিয়ে দিয়েছেন; নিজের দিকে কখনও ফিরে তাকাননি। মক্কেলরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। মামুনের মা স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। আজও তিনি শিক্ষকতা করেন এবং ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়িয়ে খুব কষ্টে সংসারের হাল ধরে আছেন। জন্মের পর বুঝতে পারার বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের এতোসব জটিল দিকগুলো দেখতে দেখতে ভিতরে ভিতরে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে মামুন। তাই কারো একটু কষ্ট বা সমস্যার কথা শুনলেই আঁৎকে ওঠে সে। সজলের হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে কিছুতেই তর সইছিল না তার।
‘কী হয়েছে তোর? বল না, কী হয়েছে।’
হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠলে মামুন উঠে দরজা খুলে দেয়। হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে মামুনের মা ঘরে ঢোকেন। সাথে বীথি। বীথির হাতে শপিং ব্যাগ।
সজল দাঁড়িয়ে সালাম জানায়। ব্যাগটা বীথির হাতে দিয়ে মা এসে সজলের পাশে দাঁড়ান।
‘কখন এসেছো বাবা? আজকাল আর তেমন আগের মতো তুমি আসো না। তোমাদের মধ্যে কোন সমস্যা হয়নি তো?’
একসাথে এতগুলো প্রশ্নের কোনটার উত্তর দেবে বুঝতে পারল না সজল। কিছুটা বোকা ও অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল সে।
বীথি এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সজলকে সাহায্য করল। বলল, ‘একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর দেবেন উনি?’
‘ও তাই তো!’
মা লজ্জিত হলেন।
‘এই তো কিছুক্ষণ হল। আপনার শরীর কেমন খালাম্মা?’
‘শরীরের আর দোষ দিয়ে লাভ কি? বয়স হয়েছে তো! এই চলে যাচ্ছে আর কি।’
কিছুটা থেমে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে মা আবারও বললেন, ‘হ্যারে বীথি, দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে? ব্যাগটা রেখে একটু চা-নাস্তার ব্যবস্থা কর। ছেলেটা কতদিন পর এসেছে। বড় হয়েছিস, এসব কি এখনো আমাকে বলে দিতে হবে?’
‘আপনি অস্থির হবেন না খালাম্মা। এই তো মাত্র এলাম।’
‘তাহলে তুমি বসো বাবা। আমি তোমাদের চায়ের ব্যবস্থা করছি।’
মা ভিতরে চলে গেলে মামুন এসে সজলের পাশে বসল।
‘বাসায় ঝগড়া করেছিস নাকি?’
কার সঙ্গে ঝগড়া করব? সংসারে তো শুধু বাবা ও ফুফু। তাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে হয় না। আমি কিছু বলার আগেই তারা বুঝে নেন, যা কিছু দরকার, চাওয়ার আগেই পেয়ে যাই। ইন ফ্যাক্ট ফুফু আম্মার মধ্যে আমি যেন মাকেই খুঁজে পাই।
সজলের জন্মের পর পর ওর মা ধনুস্টংকারে মারা যান। সজলের বাবা কিছুতেই ওর মাকে বাঁচাতে পারলেন না। চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি তিনি। তিনদিন হাসপাতালের বেডে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে স্ত্রী মারা যাবার পর সজলের বাবা শিহাব উদ্দিন চৌধুরী একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন। এতোটুকু বাচ্চার দায়িত্ব কে নেবেÑএই চিন্তায় যখন তিনি পাগলপ্রায়, তখন গ্রাম থেকে সজলের দাদা নিছার চৌধুরীর দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের বিধবা মেয়েকে সাথে নিয়ে ঢাকায় আসেন।
সজলের জন্মের পর পরই সেই থেকে ফুফু আম্মা সজলকে মায়ের মত কোলে-পিঠে করে বড় করেছেন। জন্ম না দিয়েও মায়ের আদর, যতœ, ¯েœহ-মমতায় তিনি সজলের মায়ের স্থানটা দখল করে নিতে পেরেছেন।
গরীব বাবা মেয়ের আবারও বিয়ে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়েতে মত দেয়নি মমতাজ বেগম। তার একটাই কথা, সজলকে রেখে কিছুতেই সে একদিনের জন্যও অন্য কোথাও যেতে পারবে না।
সজলের দাদা নিছার চৌধুরী মমতাজকে বিয়ে করার জন্য শিহাব চৌধুরীকে বলেছিলেন, কিন্তু তিনিও রাজি হননি। সজল জানে, তার বাবা এবং ফুফুকে নিয়ে বাইরে অনেকে অনেক কথা বলে। সজল কোন কিছুতেই কান দেয় না। বাবা ও ফুফুর ওপর সজলের আস্থা আছে যে, তারা কোন অন্যায় করতে পারেন না।
বীথি এসে চায়ের ট্রে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, ‘অতো কী ভাবছেন সজল ভাই?’
সজল যেন প্রচ- একটা ধাক্কা খেল। সত্যি সে অনেক দূর চলে গিয়েছিল।
‘না-না, তেমন কিছুই না।’
‘ভাবুন না। তাতে দোষের তো কিছু নেই। তবে চাটা যেন ঠা-া না হয়ে যায়।’
সজল এবার খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘খালাম্মা কই?’
‘মা আসছেন। ভাইয়া তোমরা শুরু করো।’
সজল বলল, ‘খালাম্মা আসুক। তারপর না হয় শুরু করা যাবে।’
‘তোমরা শুরু কর। মা গোসল সেরেই আসবেন। বাইরে থেকে এলে মা গোসল না করে পারেন না।’
‘বাইরে থেকে এলেই গোসল করেন খালাম্মা?’ সজল কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
মামুন হাসতে হাসতে বলল, ‘সুচিবাই আর কি!’
বীথি মামুনকে ধমক দিয়ে বলল, ‘এই ভাইয়া কী হচ্ছে? মা শুনলে রক্ষা নেই।’
সজল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘শুনতে পেলে কী হবে?’
‘কী আর হবে? পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর নাতিদীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিয়ে বসবেন। আর আমাদের সবাইকে তা মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে। জানেন তো সজল ভাই, যারা ছাত্র-ছাত্রী পড়ান, মানে শিক্ষকতা যাদের পেশা, তারা সবাইকে ছাত্র মনে করেন।’
মামুন বলল, ‘কথাটা কিন্তু হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক।’
কী জানি, ‘হয়ত।’ মামুন বলল।
মা এসে ওদের সাথে বসে চা খেলেন। গল্প করলেন। সজলকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ অত্যন্ত বিনীত এবং মিনতির সুরে বললেন, ‘হ্যারে সজল, মামুনটা পাস করে বসে আছে। ওকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতো পারো না। তোমার তো অনেক জানাশোনা।’
মায়ের হঠাৎ এ ধরনের কথায় মামুন ও বীথি দু’জনই লজ্জা পেল। লজ্জা এড়াতে বীথি চায়ের ট্রে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। সজলও কী বলবে বুঝতে পারল না। মামুন বলল, ‘ওকে কেন বিরক্ত করছ মা?’
মা হেসে বললেন, ‘এমন কি খারাপ বললাম।’
মামুন টি-টেবিলের ওপর থেকে একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, অবশ্যই চেষ্টা করবো খালাম্মা।
‘তুমি চেষ্টা করলে একটা কিছু হয়ে যাবে।’
মা অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বললেন।
মামুন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চল ছাদে যাই। তোর সঙ্গে কথা আছে।’
‘রাতে খেয়ে যেও কিন্তু সজল।’ মা বললেন।
‘না খালাম্মা আজ থাক, অন্য একদিন।’
‘তুমি তো সব সময় একই কথা বলো।’
‘এরপর আর বলবো না।’
চলবে