বই প্রকাশ করতে লেখকের যেসব বিষয় জানা জরুরি


ভালোমানের একটি বই প্রকাশের জন্য একজন লেখককে প্রথমে একটি পাণ্ডুলিপি  তৈরি করতে হবে। এটি একজন প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দেয়ার আগে লেখকের বেশকিছু বিষয় জানার দরকার। কী-কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লেখকের জানা থাকা দরকার, সেগুলো এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা হলো; যাতে একজন নতুন লেখক উপকৃত হতে পারেন।

পাণ্ডুলিপি তৈরির সময় যতটা সম্ভব নির্ভুল বানানের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ কথা সত্যি যে, খুব কম লেখকই আছেন, যিনি শতভাগ শুদ্ধ বানানে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে পারেন। ভুলভ্রান্তি শুদ্ধ করার দায়িত্ব প্রকাশকের হলেও লেখক এই কাজে প্রকাশককে সহায়তা করলে বইটি  প্রকাশ সহজ হয়। লেখক যে পাণ্ডুলিপি প্রকাশককে সরবরাহ করবেন, সেটি নির্ভুল করার জন্য প্রকাশক একজন প্রুফ রিডারের সাহায্য নিয়ে থাকেন। তবে পাণ্ডুলিপির ভাষা সম্পাদনার জন্য দক্ষ সম্পাদকের দরকার। অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ সম্পাদক না থাকায় প্রুফ রিডারের মাধ্যমে এই কাজটি করে থাকেন। জলছবি প্রকাশনের প্রতিটি বই নিজস্ব সম্পাদকের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়।

পাণ্ডুলিপি তো তৈরি করা হলো। লেখক প্রকাশকের হাতে সেটি তুলে দিলেন। কিন্তু বইটি  আকার কেমন হবে, কত পৃষ্ঠা হবে, কী ধরনের কাগজ ব্যবহার করা হবে, প্রচ্ছদ কী হবে-এসব বিষয় প্রকাশক ও লেখক মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন; এ জন্য এসব বিষয়ে লেখকের ধারণা থাকলে প্রকাশকের কাজটা সহজ হয়ে যায়।

অনেকেই বলেন তার ৩০টি কবিতা আছে, একটি বই প্রকাশ করতে চান তিনি। এ ধরনের লেখকের বইয়ের পৃষ্ঠা বা ফরমা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। থাকলে তিনি অমন করে বলতেন না। তাহলে কী বলতেন লেখক? এ বিষয়ে জ্ঞান থাকলে তিনি বলতেন যে, তিনি ৪৮ পৃষ্ঠা বা ৬৪ পৃষ্ঠা অথবা ৮০ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশ করতে চান।

এই যে ৪৮ পৃষ্ঠা, ৬৪ পৃষ্ঠা বা ৮০ পৃষ্ঠা বলা হলো কেন? এর কারণ হচ্ছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ফরমা হিসেবে বই ছাপেন। আমাদের জানতে হবে ফরমা কি? মনে রাখুন সাড়ে ৮ ইঞ্চি বাই সাড়ে ৫ ইঞ্চি সাইজের বইয়ে ১৬ পৃষ্ঠায় এক ফরমা হয়। এই মাপটিকে বুক সাইজ বলা যায়।

এই বিষয়টি জানা থাকলে একজন লেখক প্রকাশককে বলতে পারবেন যে, তিনি বুক সাইজ ৬৪ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশ করতে চান। সে অনুযায়ী লেখককে তার লেখা তৈরি করতে হবে। প্রকাশক তখন লেখককে জিজ্ঞেস করতে পারেন কতগুলো বই প্রকাশ করবেন। 
মনে রাখতে হবে শিশুতোষ বড় সাইজের বইগুলো ৮ পৃষ্ঠায় এক ফরমা হয়। 

বাঁধাইয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বই বাঁধাইতে শক্ত কাগজের বোর্ড ব্যবহার করা হয়। এইগুলো আবার গ্রেড অনুযায়ী হয়ে থাকে। ভালো মানের বই বোর্ড ৩২ গ্রেডের হয়ে থাকে। জলছবি প্রকাশন সব সময় ৩২ গ্রেডের বোর্ড ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়া কম দামের  বোর্ডও আছে। সেগুলো জলছবি প্রকাশন ব্যবহার করে না।

কভার কেমন হবে, সে ব্যাপারে লেখককে জানতে হবে। কভার আর্ট পেপারে ছাপাতে হয়। কভারে অনেকে ১০০ গ্রাম আর্টপেপার ব্যবহার করে থাকেন। তবে জলছবি প্রকাশন বইয়ের কভারের জন্য ১২০ গ্রাম আর্ট পেপার ব্যবহার করে থাকে। গ্রাম যত বেশি হবে, কাগজের দামও তত বেশি হবে। বইটির মানও তত ভালো হবে।

ভিতরের ছাপা কেমন হবে- সাধারণত সাদা-কালো ছাপা হয় বইগুলো। সাদাকালো বই প্রকাশ করতে এক ফরমায় একটি প্লেট ও একবার ছাপার হিসাব করতে হবে। শিশুতোষ বইগুলো চার রং প্রচ্ছদ ও চার রং ছাপা হয়। মনে রাখতে হবে, সাদাকালো ছাপার থেকে এই খরচটা চারগুণ হয়ে থাকে। কারণ প্রতিটি রঙে একটি করে প্লেট ও প্রতিটি রংয়ের একবার করে ছাপার চার্জ হিসাব করা হয়।

পুস্তানি : একটি বই কভার পেজটি উল্টালেই রঙিন একটি পৃষ্ঠা দেখতে পাওয়া যায়। অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পুস্তানি ব্যবহার করেন না, খরচ কমানোর জন্য।  লেখকরা সাধারণত এই পৃষ্ঠায় অটোগ্রাফ দিয়ে থাকেন। খরচ কম করতে অনেকে এটি সাদা কাগজ ও ৮০ গ্রাম কাগজ ব্যবহার করে থাকে। তবে জলছবি প্রকাশন এই পৃষ্ঠাটি ১০০ গ্রাম রঙিন কাগজ ব্যবহার করে থাকে। আগেই বলেছি সাদাকালোর চেয়ে রঙিন ছাপায় চারগুণ বেশি খরচ হয়।

একটি বই ছাপতে হলে কয়েকটি স্তর পার করতে হয়। প্রতিটি স্তরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন চার্জ ধার্য করা হয়।  যেমন : পাণ্ডুলিপি  সম্পাদনা, বানান সংশোধন, বই আকারে মেকআপ করা, প্লেট তৈরি করা, প্রিন্টিং মেসিনে ছাপা  এবং  বই বাইন্ডিং করা। এর উপর ভিত্তি করে প্রকাশক বইটির প্রকাশনা খরচ  হিসাব করে থাকেন। মনে করুন ৫ ফর্মার ৩০০ কপি বই ৮০ গ্রাম অফসেটে ছাপতে খরচ পড়তে পারে  ৩০ হাজার টাকা বা তার চেয়েও বেশি। অনেক প্রকাশকরা এই ধরনের বইটি ছাপতে ৬০ হাজার টাকা   থেকে ৮০ হাজার টাকাও নিতে পারেন।

 এবার আসা যাক বইটির মুদ্রিত মূল্য কত হবে। এটি প্রকাশক হিসাব করবেন। লেখক এই বিষয়টি না জানলেও চলবে। তবে ফরমা প্রতি ৩৫ টাকা ধার্য করার একটি অলিখিত নিয়ম রয়েছে। তার অর্থ ৫ ফরমার একটি বইয়ের মুদ্রিত মূল্য ১৭৫ টাকা হতে পারে। মুদ্রিত মূল্য ও বিক্রয় মূল্য এক নয়।

আইএসবিএন (ISBN) এটি একটি নম্বর। প্রতিটি বইয়ে এটি থাকতে হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় গণগ্রন্থাগার থেকে টাকার বিনিময়ে এই নম্বরটি সংগ্রহ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, আইএসবিএন ছাড়া প্রকাশিত বইটি বাংলা একাডেমির বইমেলা বিক্রি বা জাতীয় সংগ্রহশালায় জমা দেয়া যাবে না। এটি প্রকাশক সংগ্রহ করবেন। লেখকের এখানে কোনো দায়বদ্ধতা না থাকলেও প্রকাশককে সতর্ক করতে হবে। কারণ অনেক সময় আইএসবিএন ছাড়া বই প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

প্রকাশিত বইটি জাতীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করার জন্য প্রকাশক প্রতিটি বইয়ের এক কপি করে আর্কাইভে জমা দেবেন। এখানে লেখকের কোনো দায় নেই।

আরও কিছু জানতে হলে নিচে প্রকাশকের ফোন নম্বরে ফোন করতে পারবেন।


নাসির আহমেদ কাবুল
গীতিকার ও কবি
প্রকাশক, জলছবি প্রকাশন
ফোন : ০১৮১৭১২৭৮০৭

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url