ফিরে এসো নীলাঞ্জনা [৪]
রউফ সাহেব তিনদিনের জন্য দেশের বাড়িতে গেছে। রুমে একা অমিত। রাত গভীর। দুই চোখে ঘুম নেই অমিতের। শুয়ে-শুয়ে ঝিনুকের বিষয়টি ভাবছিল সে। ঝিনুকের কাছ থেকে অশালীন প্রস্তাব পাওয়ার পর দীর্ঘ দুই বছর একটি কথাও বলেনি ঝিনুকের সঙ্গে। অমিতের উদাসীনতা ঝিনুকের আত্মসম্মানে আঘাত করেছিল প্রচ-ভাবে। ক্লাসের অনেকে ঝিনুকের বিষয়টি জানত। ঝিনুক অনেকের কাছে বলে বেড়িয়েছে একদিন অমিতকে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। অমিত ঝিনুককে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেনি। তার ভাবনা জুড়ে কেবল ছেলেবেলার কিশোরী-প্রেমিকা ‘অনামিকা’।
অনামিকা কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে উঠল দিনে দিনে। অমিত যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী, অনামিকা তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। সবে যখন তারা স্তনযুগল কলি হয়ে ফুটে উঠছে। কবি আলাওলের ভাষায় স্তনযুগল নারঙ্গ লেবুর মতো হয়ে উঠছে; মেয়েদের ওই বয়সে না বোঝার কিছু থাকে না। অমিতের চোখের ভাষা সে বুঝতে পারত। অনামিকাও অমিতের চোখে চোখ রেখে তার মনের কথা বলেছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনি অমিত।
এসএসসি পাস করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হয় অমিত। সুযোগ পেলেই বাড়িতে চলে যেত সে। অমিতের বাসা থেকে অনামিকার বাসা দূরে নয়। মাঝখানে বিশাল একটি দিঘি। অনামিকার বাসার সামনে সানবাঁধানো ঘাটে বসলে অমিত অনামিকাকে দেখতে পেত। যতক্ষণ সূর্যের আলো থাকত, অমিত বসে থাকত অনামিকাদের বাসার দিকে তাকিয়ে। যেন চ-িদাশ, যদি একটি খোট মেলে!
একদিন পড়ন্ত বিকেলে টিপ-টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। চ-িদাসের খোট মিলেছিল সেদিন। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দিঘির পাড়ে গিয়ে অনামিকাকে দেখার কোনো সুযোগ না থাকায় বারান্দায় বসে হারমোনিয়াম নিয়ে অমিত গান গাইছিলÑ
‘ঝিলের জলে কে ভাসালে
নীল শালুকের ভেলা
মেঘলা সকাল বেলা।...’
গান গাইতে-গাইতে খুব আনমনা হয়ে পড়েছিল অমিত। হঠাৎ তার চোখ পড়ে অনামিকার চোখে। অনামিকা অমিতদের ঘরের মধ্যে থেকে পর্দা সরিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়েছিল অমিতের দিকে। অনামিকার চোখে চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে থেমে গিয়েছিল অমিতের কণ্ঠ। ততক্ষণে অনামিকা সরে গেছে পর্দার ওপাশ থেকে। অমিত শূন্যদৃৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বিবর্ণবিষাদে আত্মহারা হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম সরিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল দিঘির পাড়ে। অমিত দেখল ওপারে এক কিশোরী বৃষ্টির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জলে। চৌদ্দ বসন্তের সেই কিশোরী অনামিকা! অমিতের কণ্ঠ হতে ধীরে লয়ে বেরিয়ে এসেছিল-
শতরূপে শতবার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।’
বৃষ্টির মধ্যে দিঘির জলের সঙ্গে উচ্ছ্বাস-আলিঙ্গন চলছিল অনামিকার। আর তখন হৃৎসাগরে প্রচ- ঢেউয়ের দোলায় হালভাঙ্গা নাবিকের মতো বেসামাল হয়ে পড়েছিল অমিত। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই পালাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে অনামিকা। তখন ভেজা কাপড়ে অনামিকাকে দেখে অমিতের মনে হয়েছিল কিশোরী নয় সে, সে যে পূর্ণযৌবনা! ভেজা কাপড়ে অনামিকাকে অপূর্ব লাগছিল তার। অমিতের চোখে সেদিন নতুন রূপে ধরা দিয়েছিল কিশোরী মেয়েটি। সেদিনই সে প্রথম আবিষ্কার করেছিল নারীকে ভালোবাসার আরো একটি দিক আছে, সে হচ্ছে নারীর যৌবন।
হঠাৎ অমিতের মনে পড়েছিল ঝিনুককে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের সেই দুরন্ত যৌবনকালে অমিত একেবারেই ছিল নিস্পৃহ। সে তো অনামিকার কারণে। কিন্তু ঝিনুক, ঝিনুক তো একেবারেই নিস্পৃহ ছিল না, থাকার কথাও নয়। তার হৃদয়ে তো অন্য কোনো পুরুষের আসন ছিল না। হয়তো অমিতই ছিল তার আরাধ্য পুরুষ। তাকে নিয়ে যদি একজন পূর্ণযৌবনার মনে কোনো কামনা জাগে তাতে কী দোষ তার? জোয়ারের জলে বাঁধ দিয়ে কে ঠেকাতে পেরেছে কবে? যৌবন তো জোয়ারের মতোই। প্রেম ও যুদ্ধে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। ঝিনুক তো অমিতকে পেতে চেয়েছিল। এই চাওয়ার মধ্যে কি কোনো অন্যায় ছিল? অমিতকে জয় করার এই যুদ্ধে ঝিনুক যদি নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়, তাতে কী দোষ ঝিনুকের? অবাধ্য পুরুষকে বাগে আনতে এটাও তো নারীর শাশ্বত অস্ত্র। এমন যুদ্ধে কোনো পাপ থাকতে পারে না। পাপ-পুণ্য দূরে ঠেলে কাউকে জয় করার প্রাণপণ চেষ্টাই তো আসল! অমিতের মন গলতে শুরু করে। তারপর গলে একদম পানি হয়ে যায়। ঝিনুকের প্রতি যত রাগ, যত অনীহা উবে যায় মুহূর্তে।
অনামিকা ভেজা কাপড় সামলাতে-সামলাতে আরো একবার তাকিয়েছিল অমিতের দিকে। অমিতের দৃষ্টি ছিল তখন নিষ্পলক। অনামিকার ওড়না তখন পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছিল। লজ্জায় রক্তিম হচ্ছিল অনামিকা। তারপর খুব দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন। তবুও ওপাড়ে সানবাঁধানো ঘাটের দিকে অমিত অনিমেষ তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ। এসব পুরোনা কথা মনে করতে-করতে অমিতের স্মৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একদিনের স্মৃতি ভেসে উঠেছিল। কলাভবনের ক্লাসে কবি আলাওলের পদ্মাবতী পড়াচ্ছিলেন নরেন বিশ্বাস স্যারÑ
যাহারে হেরএ তার হানএ পরান ॥
ভুরু ভঙ্গ দেখি কাম হইলা অতনু।
লজ্জা পাই তেজিল কুসুম্ব শরধনু ॥
ভুরুধনু গুণাঞ্জন বিশিখ কটাক্ষ।
ত্রিভুবন শাসিল করিয়া সেই লক্ষ্য ॥
কদাঞ্চিৎ গগনে উগিলে ইন্দ্রধনু।
ভুরুভঙ্গ দরশনে লুকাএ নিজ তনু ॥
ভুরুর ভঙ্গিমা হেরি ভুজঙ্গ সকণ।
ভাবিয়া চিন্তিয়া মনে গেল রসাতলে ॥’
হঠাৎ স্যারের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় কামালের ওপর। কামাল হয়তো ঘুমে ঢলে পড়ছিল। স্যার কয়েক মুহূর্ত কামালের দিকে চেয়ে থেকে রেগে বললেন, ‘এই ছেলে দাঁড়াও তুমি!’ কামাল সেদিন দাঁড়ালে ক্লাসের সবগুলো চোখ কামালের ওপর গিয়ে গিয়ে পড়ে। স্যার বললেন, ‘তোমার বয়স কত?’
কামাল বলেছিল, ‘কুড়ি বছর।’
নরেন বিশ্বাস স্যার সচরাচর রাগেন না। কিন্তু সেদিন স্যারের রাগ চরমে পৌঁছেছিল। স্যার বললেন, ‘আমি পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা করছি, আর তুমি কুড়ি বছরের যুবক ঘুমাচ্ছ! বের হও আমার ক্লাস থেকে!’ কামাল পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। রূপ বর্ণনায় পদ্মাবতীর স্তন নারাঙ্গ লেবুর মতো বর্ণনাকালে ক্লাসের সব মেয়েই মাথা নিচু করে বসেছিল। অমিতের আজ সে কথা মনে পড়ে। ভেজা কাপড়ে অনামিকার স্তন নারাঙ্গর মতো তার চোখে ধরা দেয়। সেদিন সেই প্রথম অনামিকার মধ্যে সে নারীর প্রকৃত রূপ দেখতে পেয়েছিল।
ভাবতে-ভাবতে কখন সময় মধ্যরাতে গড়িয়েছিল খেয়াল নেই অমিতের। হঠাৎ ফোনকলে সম্বিত ফিরে পায় সে। ফোনসেট হাতে নিয়ে নম্বরটা চিনতে পারে। গত এক মাস ধরে এই নম্বর থেকে তার কাছে অসংখ্যবার ফোন এসেছে। কোনো কোনোবার সে ফোনে সাড়া না দিয়ে সুইচ অফ করে রেখেছে। আজ এই মুহূর্তে অমিতের মনটা পেজা তুলোর মতো উড়ছে। যেন ভেসে যাওয়ার জন্যই সে। যেন সব অস্তিত্ব সব অহংকার বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে আজ একেবারে। এই মুহূর্তে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তার। সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে সে। ঝিনুকও নিঃশর্ত ক্ষমা পেয়ে গেছে আজ।
অমিত ফোন রিসিভ করলে অন্যপ্রাপ্ত থেকে খুব অনুযোগের সুরে একটি কথা ভেসে আসে-
‘তুমি এত নিষ্ঠুর কেন?’
চারটি শব্দের এই একটিমাত্র অনুযোগে আহত হয় অমিত। কই সে তো কখনো কারো প্রতি কোনো অন্যায় করেনি! কাউকে কষ্ট দেয়নি সে। তাহলে আজ এই অভিযোগ কেন? কে এই নারী? যে অমিতকে এভাবে বলতে পারে!
ওপাশ থেকে আবারও মিষ্টি মোলায়েম কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘কথা বলছ না যে!’
‘কী কথা বলব?’
‘আমি তো তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি। তুমি কেন এত নিষ্ঠুর?’
‘আমি জানি না কার প্রতি আমি নিষ্ঠুর আচরণ করেছি। এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই আমার। তুমি কেন বার-বার আমাকে বিরক্ত করছ? কে তুমি? কী চাও?’
‘নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকা ভালো। তবে অন্যের অভিযোগকে যে গুরুত্ব দেয় না সে আসলে বোকা। নয়তো জেনেও সবকিছু গোপন করতে চাইছ।’
‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?’
‘হাজারটা করতে পারো।’
‘কে তুমি? কেন বিরক্ত করছ আমাকে?’
‘তোমাকে বিরক্ত করছি না অমিত। আর আমি? আমি তোমার বন্ধু।’
অমিত হাসে। বিদ্রƒপের সে হাসির শব্দ ওপাশে যে ফোনে কান রেখে বসে আছে তার মস্তিষ্কে ঝড় তোলে। তবে দমে যায় না সে। পাল্টা প্রশ্ন করে বলে, ‘তোমার স্মৃতিশক্তি এতটা জং ধরল কবে থেকে অমিত? আমার কণ্ঠস্বরও ভুলে গেছ!’
‘তুমি আমার নাম জানো?’ আশ্চর্য হয় অমিত।
‘বন্ধুর নাম জানব না? যার সঙ্গে ডিপার্টমেন্টে এতটা বছর কাটালাম, তার নামটা ভুলে যাব! আমি কি তুমি? তোমার মতো এতটাই ভুলো মন আমার?’
আপন মনে উচ্চরণ করে অমিত, ‘ডিপার্টমেন্টে এতটা বছর!’ কিন্তু কে এই নারী। স্মৃতির পাতা হাতড়াতে থাকে সে।
‘কী কথা বলছ না কেন?’
অপর প্রান্ত থেকে খুব মোলায়েম একটি কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘অমিত তোমাকে আমার খুব দরকার। খুউব। বিশ্বাস করো, আমার জীবনের এই চরম অসময়ে তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে ভরসা করতে পারছি না।’
‘কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনি না!’
‘তুমি আমাকে চেনো না, সেটা ঠিক নয়। তবে তুমি মনে করতে পারছ না। আর সে জন্য তোমার কোনো দায় নেই। আমাকে মনে রাখার মতো এমন কিছু করতে পারিনি তোমার সঙ্গে যাতে তুমি আমাকে মনে রাখতে পারো। আমি সে জন্য দুঃখিত অমিত। তবে এই বিপদের সময় আমি তোমার সাহায্য চাই, অন্তত পরামর্শ তো দিতে পারো।’
‘তোমার নামটা বলো।’
‘নাম বলব না। তোমাকে সেটা খুঁজে নিতে হবে।’
‘তাহলে ফোন রাখছি। যে নিজের পরিচয় গোপন রাখে তার সঙ্গে দীর্ঘসময় আলাপচারিতা হতে পারে না।’
অমিত লাইন কেটে দেয়। তারপর ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরায়। অমিতের ফোনসেট পড়ে থাকে রুমে।