ফিরে এসো নীলাঞ্জনা [শেষ পর্ব]

 


এগারো

শেষ পর্ব

ঝিনুক অমিতকে দীর্ঘ একটি চিঠি লিখেছেন, ঝিনুক লিখেছে, ‘তোমাকে না পাওয়ার বড়ো ব্যর্থতা আমার। আমি তোমাকে সামনে দেখব, অথচ স্পর্শ করতে পারব না, সে কষ্টটা আমি মেনে নিতে পারিনি। যখনই তোমার সঙ্গে দেখা হতো, তখনই তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করত আমার। অথচ তুমি আমাকে এমনভাবে বঞ্চিত করলে যে, পালিয়ে বাঁচা ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা রইল না। তুমি আমারই সামনে অথচ তুমি আমার নওÑএভাবে চলতে থাকলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না। আমি দেশ ছেড়ে চলে গেলাম। হয়তো ফিরব, হয়তো ফিরতে পারব না। যদি কখনো ফিরে আসি জীবনের সেই গোধূলি বেলার শেষ রশ্মিটুকুতেও যদি তোমাকে পাই সেই আশায়। হয়তো তখন তোমার মন ফিরতে পারে। কিশোরীর মেয়ের জায়গাটিকে তুমি আমাকে দিতেও পারো। সেই আশাটুকুই আমার শেষ সম্বল।

সম্পত্তির সবটুকুই তোমাকে দিয়ে গেলাম। যিনি আমাকে তার সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, তিনি আমার বাবা নন। গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে আসার সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয়। এই ভদ্রলোক আমাকে আশ্রয় দিলেন। আমার মতো একটি মেয়ে তার ছিল, যে মেয়েটি ক্যান্সারে মারা যায়। তিনি আমার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে চাইতেন বলে আমি তাকে বাবা ডাকতাম। গ্রামে আমার মা ও বাবা থাকতেন। খুব কম বয়সে বাবা আমাকে বিয়ে দেবেন বলে পালিয়ে এসেছিলাম ঢাকায়। আমার একটি ছোটো বোন আছে। তার বিয়ে হয়ে গেলে বিদেশে চলে গেছে। মাকে বাবা ঠা-া মাথায় খুন করেছে। এ জন্য তার ফাঁসি হয়েছে। খুব কম বয়সে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করিনি বলে বাবা আমাকে ত্যাজ্য করে দিয়েছে। গ্রামে আমি কীভাবে ছিলাম, কেন কীভাবে ঢাকায় এলাম তার সবকিছু তোমাকে এই চিঠিতে লিখে গেলাম।

আমার আসল নাম অতসী। ঝিনুক নামটা আমার আশ্রয়দাতা বাবা দিয়েছেন। কারণ তার মেয়ের নাম ছিল ঝিনুক। আমি আগেই বলেছি, তার মেয়েটি ক্যান্সারে মারা গেছে। আমার গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। আমার বাবা খুব একরোখা ছিলেন। তিনি যা বুঝতেন তাই করতেন, কারো মতামতের কোনো মূল্য দিতেন না। তাকে দেখলে মনে হতো, সবার উপর সে বিরক্ত। আমি ও আমার ছোটো বোন শ্রেয়সীকে সারাক্ষণ বকাঝকা করত। এটা তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাবার কাছ থেকে আদর-¯েœহ বলতে কিছুই পাইনি আমরা দুই বোন। বাবা নিজে জীবনে কারো ভালোবাসা পায়নি বলে হয়তো অমনটা হয়েছে। কোনো সন্তান তার মায়ের অপমান সহ্য করতে পারে না। বাবা একদিন মায়ের মুখে জ্বলন্ত চেলাকাঠ দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। আমি দৃশ্যটি দেখে ফেলে চিৎকার করে বলি, ‘খবরদার মাকে ছেড়ে দাও, না হলে তোমাকে খুন করে ফেলব!’ আমার বয়স তখন সাত বছর। আমি জানি না, কী করে বাবাকে এমন করে বলতে পারলাম! এ জন্য পরে মনে মনে হাজারবার অনুতপ্ত হয়েছি। বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। বাবা এরপর থেকে আমাকে একদম সহ্য করতে পারত না। আমিও সব সময় বাবাকে এড়িয়ে চলতাম। বাবা যতক্ষণ বাসায় থাকত, ততক্ষণ আমরা দুই বোন পালিয়ে বেড়াতাম। মা-ও বাবার মুখোমুখি হতে ভয় পেতো। পান থেকে চুন খসলে তেড়ে ওঠত বাবা। কথায় কথায় মাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। অথচ বাবা-মা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। দুজনে একই কলেজে অ্যকাউন্টিংয়ে পড়াশুনা করত। বারবার চিঠি লিখেছিল মাকে। প্রতিটি চিঠি মা ছিঁড়ে ফেলেছে। কোনো চিঠির উত্তর দেয়নি। শেষে একটি চিঠিতে মা বাবার প্রস্তাবে রাজি না হলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিল। মা এতে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তারপর বন্ধুদের অনুরোধে বাবার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় শুরু করে মা। এভাবে একদিন তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হলে ধীরে-ধীরে মাও বাবাকে ভালোবেসে ফেলে। পরে পালিয়ে বিয়ে করে দুজনে।

প্রেম করে বিয়ে করলে ভালোবাসা বাসি হয়ে যায়। বিরহে প্রেম সত্য। কাক্সিক্ষতজনকে যতক্ষণ না পাওয়া, ততক্ষণই প্রেম-ভালোবাসা। হাতের কাছের জিনিস সস্তা মনে হয়। মাকে বিয়ে করার পর দিনে দিনে তার প্রতি বাবার আকর্ষণ কমতে থাকে। তারপর মায়ের প্রথম সন্তান অর্থাৎ আমি ভূমিষ্ট হওয়ার পর মায়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা তলানিতে পৌঁছে যায়। মনে হয়, সে মাকে বিয়ে করে ভুল করেছে, তাকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে সে আরো বেশি সুখি হতে পারত।

মাকে বিয়ে করে বাবা তার বড়ো চাচার বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। সেখানে চাচার ব্যবসা দেখাশুনার ভার পড়ে তার উপর। কিন্তু হঠাৎ একদিন পারিবারিক বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে চাচার সঙ্গে ঝগড়া হয় বাবার। তারপর রাতে ঝড়ের মধ্যে চাচার বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় বাবা।

বিয়ের কিছুদিন নাকি তারা বেশ শান্তিতেই ছিল। আমার জন্মের পর পরই শুরু হয় মনোমালিন্য। বাবা-মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া, মারামারি লেগেই থাকত। মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জন্মের পর বাবা আমাকে একনজর দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। মাও আমাকে জন্ম দিয়ে খুশি হতে পারেননি। দাদী নাকি বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ইস কী কালো হয়েছে মেয়েটি! ওর পা দুটিও তো কেমন বাঁকা হয়েছে। কোথা থেকে এলো এই অলক্ষুণে মেয়েটি!

আমার জন্মের পর দিনে-দিনে বাবা উন্মাদের মতো হয়ে গেলেন। কথায়-কথায় মাকে মারধর করত। খুব ছোটবেলায় একবার আমার বসন্ত হলে মুখে প্রচুর দাগ হয়েছিল। তাছাড়া আমার গায়ের রংও কালো। বাবা হয়েও সে আমাকে খোঁটা দিতে একটুও কার্পণ্য করত না। খোঁটা দিয়ে বলত, তুই অত কালো কেন? তোর মুখভর্তি দাগ। খুব বিচ্ছিরি লাগে তোকে।

বাবার কথা শুনে একা-একা কাঁদতাম আমি। মাও আমাকে কখনো সান্ত¦না দিতে আসত না। বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি দেখে বড়ো চাচী খুব খুশি হয়েছিল। সে কখনো বাবা-মায়ের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। তার ইচ্ছা ছিল বাবার সঙ্গে তার চাচাতো বোনের বিয়ে দেবে। তার ইচ্ছে পূরণ হয়নি বলে অত্যন্ত ক্ষেপে যায় বাবা ও মায়ের ওপর। আমার জন্মের পর সে একনজর দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেছিল, ওর মায়ই অপয়া। না হলে অমন কালো মেয়ে হয়? নিজের চেহারা তো নায়িকার মতো, অমন মেয়ে পেটে আসে কী করে! বাবাও স্বীকার করতেন না, আমি তার সন্তান। তিনি মাকে সন্দেহ করতেন। বড়ো চাচী এ কথাগুলোই বিভিন্নজনের কাছে বলে বেড়াত। আমি বড়ো হয়েও শুনেছি এই কথা। বড়ো চাচী কোনো এক তান্ত্রিককে দিয়ে বাবাকে যাদুটোনা করে রেখেছিল যাতে মা ও আমাকে সহ্য করতে না পারে, সংসারে অশান্তি হয়। তার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। কথায়-কথায় বাবা মাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। প্রথম-প্রথম মা বাবার কথায় কষ্ট পেয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করত। মনে করত সন্তান হলে হয়তো তার স্বভাবের পরিবর্তন হবে। অন্তত সন্তানের মুখের দিতে তাকিয়ে নিজেকে শুধরে নেবে। কিন্তু না, তেমন কিছুই হয়নি। দিনের পর দিন বাবার অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়। মা সব মুখ বুজে সহ্য করে মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে। তার ইচ্ছা মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে, ওরা বড়ো হয়ে ওদের বাবার অত্যাচার থেকে ওদের মাকে রক্ষা করবে।

সাত বছর বয়সে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় সরকারি প্রাইমরি স্কুলে। সেখানেও স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীদের সমালোচনা শুনতে হয়েছে আমাকে। স্কুলে আমার তেমন বন্ধু হয়নি। দু-একটি ছেলে বন্ধু হলেও তারা আমাকে ভালোবাসতো না। সবাই কেমন যেন তাচ্ছিল্যের চোখে তাকাত আমার দিকে। স্কুলের এক শিক্ষক সবাইকে ছুটি দিয়ে আমাকে অশ্লীলভাবে আদর করত। আমি প্রতিবাদ করতে পারতাম না। দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠলে মাকে বিষয়টি জানালে মা কিছুই বলেনি! 

এক সময় ব্যবসা করার জন্য বাবা পরিবার নিয়ে বগুড়া শহরে চলে আসে। নতুন ব্যবসা, আয়-ইনকাম সামান্যই। শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকা প্রায় অসম্ভব। এ জন্য ছোটো খালার বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকার সুযোগ হয় আমাদের। পাঁচতলা বাড়িটির দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ে মায়ের ওপর। বাড়ির দায়িত্ব নেওয়ায় কোনো ভাড়া দিতে হতো না মাকে। বাড়িটা পেয়ে বাবাও বেশ খুশি হয়েছিল। এ জন্য শালীর সঙ্গে তার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাবার ভায়রাভাই বিদেশে থাকায় শালীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কও নাকি গড়ে উঠেছিল বাবার! বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হলে এই কথাগুলো উঠে আসত প্রায়ই। আর তখনই তাদের কথা শুনে ফেলে আমি। মাত্র দশ-বারো বছর বয়সে আমি নারী-পুরুষের সম্পর্কটা বুঝতে পারতাম। রাতে পাশের রুমে মা ও বাবা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু কথাবার্তা ও শব্দ আমার কানে ভেসে আসত। এ কারণে ওই বয়সেই আমি নারী-পুরুষের গোপন বিষয়টির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। বান্ধবীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করতাম। মায়ের কাছে বিষয়টি গোপন থাকেনি। একদিন এ নিয়ে আমাকে মারপিট করলে আমি মাকে বলেছিলাম, তোমরা রাতে অমন শব্দ করো কেন? সবই তো শুনতে পাই আমি! তোমাদের শব্দ যাতে কানে না আসে সে জন্য কানের ওপর বালিশ চাপা দিতে ঘুমাতে হয় আমাকে!

আমার কথা শুনে মা আর কথা বাড়ায়নি এবং পরবর্তীতে আমার এই আগ্রহের ব্যাপারে কোনো বাধা দিতেও যায়নি। ফলে আমি দিনে-দিনে ছেলে বন্ধুদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি।

ছোটো বোনের বাড়ির দেখভাল করতেন মা। বাড়ির নিচেতলায় একটি প্রাইভেট কোম্পানীর অফিস ছিল। সেখানের কয়েকজন কর্মচারী আমাকে মৌমাছির বাসা দেখানোর নাম করে রুমে নিয়ে যৌননির্যাতন করতে চেয়েছিল। একদিন প্রতিষ্ঠানের মালিক ভিজিট করতে এলে মা আমাকে নিয়ে তার কাছে যায়। কোনো একটা অজুহাতে আমাকে রেখে মা উপতলায় গেলে ষাট বছরের বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বুকে জাপটে ধরে। বুকে-পিঠে হাত দেয়, ঠোঁট চেপে ধরে আমার ঠোঁটে। আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিৎকার করি আমি। হঠাৎ একজন কর্মচারি এসে পড়ায় আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল বৃদ্ধ লোকটি। আমি এ কথা মাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু মা আমার কথায় একদম কান না দিয়ে নিজের কাজে চলে গিয়েছিলেন। মা কেন এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি, সেটা আমার কাছে আজও বিস্ময়। এরপর থেকে মায়ের প্রতি আমার এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম নেয়। মনে-মনে ঘৃণা করতে থাকি মাকে। 

আমার খালাতো ভাই রবিন। আমার চেয়ে দুবছরের বড়ো। দুজনে একই বাসায় বড়ো হয়েছি। ছোটবেলা থেকে রবিন আমার সঙ্গে খুব একটা ভালো ব্যবহার করত না। মাঝে মধ্যে এমনভাবে তাকিয়ে থাকত যে, আমার খুব খারাপ লাগত। রবিনের বয়স তখন ষোলো। একদিন একা বাসায় পেয়ে রবিন আমাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে ছোটো বোন শ্রেয়সী চলে এলে আমাকে ছেড়ে দেয় রবিন। শ্রেয়সী বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারেনি। সে মনে করেছে, রবিন হয়তো আমাকে মারছে। শ্রেয়সী এসে রবিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আমার ও শ্রেয়সীর ধাক্কা সামলাতে না পেয়ে খাট থেকে ছিঁটকে পড়ে রবিন। এতে তার মাথা ফেটে যায়। তবে এ কথা সে কাউকে বলেনি। বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, কেন সবাই আমার সঙ্গে এমন আচরণ করছে বুঝতে পারি না। আস্তে-আস্তে ছেলেবন্ধুদের প্রতি আমার এক ধরনের রোষ সৃষ্টি হয়, এড়িয়ে যেতে থাকি ছেলেদের।

রবিনের মাথা ফেটে গেলে রক্ত দেখে ভয় পেয়ে যাই আমি। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। আমি রবিনের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলে রবিন ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে যায়। রবিনের কেন মাথা ফেটেছে, এ কথা যেন কেউ জানতে না পারে সে ব্যাপারে শ্রেয়সীকে নিষেধ করে দিই আমি। এরপর থেকে রবিন আমাকে দেখলে এড়িয়ে যেত। এতে আমার খুব খারাপ লাগত। রাতে পড়ার টেবিলে বসে ছোটো একটি চিঠিতে রবিনকে উদ্দেশ করে আমি লিখিÑ‘ভাইয়া, তুমি আমার চেয়ে দুবছরের বড়ো। কখনও তোমাকে ভাইয়া ডাকিনি। আজ মনে হলো কাজটা ঠিক করিনি আমি। তাছাড়া ওইদিন তোমাকে অতটা জোরে ধাক্কা দেওয়াও ঠিক হয়নি। ভাইয়া, তুমি তো আমার বড়ো ভাই। হোক না খালাতো। তুমি কি আমার সঙ্গে অসভ্যতা করতে পারো? একবার ভেবে দেখো। তোমার যদি মনে হয়, তুমি ঠিক করেছ তাহলে তুমি যা বলবে, আমি তাই করব।’ ইতি তোমার ছোটবোন অতসী।

চিঠিটা শ্রেয়সীকে দিয়ে রবিনের কাছে পাঠিয়ে দিলে চিঠি পেয়ে রবিন কোনো কিছুই বলেনি। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে রবিনের সঙ্গে দেখা হলে রবিন আমার কাছে ক্ষমা চায়। আমি অবাক হয়ে বলি, ছিঃ তুমি কেন ক্ষমা চাইবে! তুমি তো আমার বড়ো ভাই। এরপর দিনে-দিনে দুজনের মধ্যে ভাইবোনের সম্পর্কটা আরো জোরালো হয়ে ওঠে।

কিছুদিন পর আমার এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ। সেবার রবিন এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। মাঝে মধ্যে রবিন আমাকে পড়া বুঝিয়ে দিতো। আমি এসএসসিতে সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হই। এইচএসসি পাস করে রবিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। রবিন যেদিন ঢাকা চলে যাবে সেদিন আমাকে ডেকে বলে যে কোনো সমস্যা হলে যেন রবিনকে খবর দিই। রবিন ঢাকা গিয়ে তার হলের ঠিকানা দিয়ে আমাকে চিঠি লিখে। এরপর মাঝে মধ্যে রবিনের সঙ্গে আমার চিঠি আদান-প্রদান চলতে থাকে।

একদিন কলেজ থেকে এসে আমি দেখি মা বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বাবা তাকে এত অত্যাচার করেছে তবু আমার মা কখনো কাঁদেনি। আজ এমন কী হলো যে, মা এত কান্নাকাটি করছে! শ্রেয়সীও কিছু জানে না। তবে বাবা-মায়ের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়েছে, এটুকুই বুঝতে পেরেছে।

আমি মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু কী বলবে বুঝতে না পেরে মায়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘কাঁদছ কেন মা? বাবা মেরেছে তোমাকে? কই তুমি তো কখনো কাঁদো না। তবে আজ এমন কী হলো যে তোমাকে কাঁদতে হবে?’

মা বিছানা থেকে উঠে বসে আঁচলে চোখ মুছতে-মুছতে বলে, ‘এটা আমি কিছুতেই হতে দেবো না! তোর বাপ আমার জীবনটা নষ্ট করেছে। কথা ছিল বিয়ের পর আমি লেখাপড়া করব, চাকরি করে স্বাবলম্বী হব। কিন্তু সে কথা রাখেনি। আজ তোর সর্বনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে?’

আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, মা কী বলতে চাইছে। বললাম, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মা, তুমি কী বলছ এসব?’

মা বলল, ‘তোর বাপ তোর বিয়ে ঠিক করেছে। এ মাসেই তোকে দেখতে আসবে। ছেলে বিদেশে থাকে। বিয়ে হলে তোকে নাকি বিদেশে নিয়ে যাবে। আমি তার কথায় রাজি হয়নি বলে ভীষণরকম মেরেছে আমাকে! বিয়ে হয়ে গেলে তোর আর লেখাপড়া হবে না। কত আশা আমার মেয়ে দুটিকে পড়াশুনা করিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলব, যেন আমার মতো স্বামীর হাতে মার খেতে না হয়।’

আমি বললাম, ‘আমি এ বিয়ে মানি না মা।’ মা বললেন, ‘কী করবি তুই? তোর বাপকে তো জানিস। জোর করে বিয়ে দেবে।’ মা কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন, ‘মাথা গরম করিস না। একটা বুদ্ধি তো করতেই হবে, না হলে তোর জীবনও আমার মতো হবে। এটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না।’

বললাম, ‘কী করব তাহলে?’

মা বললেন, ‘তোকে পালাতে হবে। ট্রেনের টিকিট কেটে আনব আমি। কাল রাতের ট্রেনে তুই ঢাকায় যাবি। ওখানে গিয়ে আমার এক বান্ধবীর বাসায় উঠবি। আমি চিঠি লিখে দেবো।’

এর একদিন পর আমি একা একা গিয়ে ট্রেনের উঠলাম। আমি ট্রেনে উঠলে আমার পাশেই এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী ছিলেন। আমি অনেক রাত পর্যন্ত জানালা দিয়ে তাকিয়ে কাঁদছিলাম। তারা আমাকে বলেন, তুমি একা? এরপর অনেক কথা হলো তাদের সঙ্গে। আমার মনটা খুব ভারাক্রান্ত ছিল। এ সময় মানুষের মন সহজ হয়ে যায়। আমি কেমন করে যেন আমার জীবনের সব কথা তাদেরকে খুলে বললাম। তারা তখন বললেন, যে তাদের একটি মেয়ে ছিল, নাম ঝিনুক। ঝিনুক ক্যান্সারে মারা গেছে ছোটবেলায়। সে আমাকে তাদের বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলে আমি রাজি হয়ে যাই। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা। আমার ইচ্ছা ছিল তোমাকে আমার জীবনের সব কথা বলব। কিন্তু সে সুযোগ হয়নি আমার! তুমি সময় দাওনি। এ জন্যই একদিন বলেছিলা, বাবা-মা বাসায় থাকবে না, তুমি এসো। তুমি ভুল বুঝলে আমাকে!

অমিত, বাসার চাবি কেয়াটেকারের কাছে রেখে এসেছি তোমাকে দেওয়ার জন্য। তুমি সেখানেই থেকো। ফ্যাক্টরিতে ম্যানেজারকে তোমার কথা বলে এসেছি। তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফ্যাক্টরি দেখাশুনা করো। মনে রেখো এ সম্পত্তি তোমার। জানি না, আমি কোনোদিন আর ফিরব কি না। যদি কোনোদিন মনে হয়, তুমি আমাকে মিস করছ, সেদিন হয়তো ফিরব। তখন কি আমাদের এই দিনগুলো থাকবে? হয়তো থাকবে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’ সূর্যের শেষরশ্মির ঔজ্জ্বল্যে আমরা কি তখন ফিরে পাবো আমাদের হারানো অতীত? সব বয়সেরই একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে অমিত। যৌবনে তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম। তুমি ছিলে কাছাকাছি, তবুও স্পর্শের বাইরে ছিলে। সেই দিনগুলোর আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতি। তবে আজ মনে হয় সেই দিনগুলোই ছিল আমার সব আনন্দের উৎস। চবৎপু ইুংংযব ঝযবষষবু-’র একটি কবিতার কথা মনে পড়ে প্রায়ই।


ুডব ষড়ড়শ নবভড়ৎব ধহফ ধভঃবৎ,

অহফ ঢ়রহব ভড়ৎ যিধঃ রং হড়ঃ;

ঙঁৎ ংরহপবৎবংঃ ষধঁমযঃবৎ

ডরঃয ংড়সব ঢ়ধরহ রং ভৎধঁমযঃ;

ঙঁৎ ংবিবঃবংঃ ংড়হমং ধৎব ঃযড়ংব ঃযধঃ ঃবষষ

ঙভ ংধফফবংঃ ঃযড়ঁমযঃ.”


তোমাকে আমি ফোন নম্বর দেবো না। তুমি আমাকে খুঁজেও পাবে না। আমি তোমাকে কষ্টের আগুনে পোড়াব, আমি যেমন পুড়েছি পনেরোটি বছর। আমি দেখতে চাই তুমিও আমার মতো পুড়ে-পুড়ে খাঁটি সোনা হও কি না।

ইতি ঝিনুক


ঝিনুকের চিঠি পড়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ে অমিত। তার মনে হতে থাকে কিশোরী অনামিকার আজ আর কোনো স্মৃতি তার মনে স্পষ্ট নেই। আজ তার অস্থিত্ব জুড়ে শুধুই ঝিনুক। এখন শুধু ঝিনুককে খুঁজে ফেরে সে। বার বার নিজের মনে উচ্চারণ করতে থাকে, ফিরে এসো নীলাঞ্জনা, ফিরে এসো আর একবার। অমিত অনামিকাকে নীলাঞ্জনা নামে ডাকত। নীলাঞ্জনা বলতে এখন অমিত শুধু ঝিনুককেই মনে করে। 


কুড়ি বছর পর

কুড়ি বছর পর মাত্র দুলাইনের একটি চিঠি পায় অমিত। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার ফেডএক্স চিঠিটি দিয়ে গেছে গতকাল। সোমবার ২শে জুন ঝিনুক ফিরে আসবে বলে জানিয়েছে। ফ্লাইট নম্বর বলেনি, সময়ও জানায়নি! কোন দেশ থেকে আসছে, তাও বলেনি! তবে খামের ওপর ভিয়েনার ঠিকানা দেখে বুঝতে পেরেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসছে ঝিনুক। 

সকাল দশটায় চিঠি পাওয়ার পর অস্থির সময় কেটেছে অমিতের। অমিত এখন একা চলাফেরা করতে পারে না। হুইল চেয়ার ছাড়া একচুলও নড়ার ক্ষমতা নেই তার। ঝিনুকের চাচার পিস্তলের গুলি থেকে কোনোরকম বেঁচে গেলেও চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে সে। একদম মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে অমিত, মরেনি। ওই যে বলে না, রাখে আল্লাহ মারে কে? শেষমেশ ঝিনুকের চাচাকে নিজের দলের লোকের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে। 

এই বিশটি বছর অমিত প্রতিদিন ফ্যাক্টরিতে গেছে। দিনরাত পরিশ্রম করে ফ্যাক্টরিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছে। এখন দেশ-বিদেশে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন ফ্যাক্টরি। দীর্ঘ কুড়ি বছরে ফ্যাক্টরি থেকে একটি পয়সাও নিজের জন্য খরচ করেনি সে। লাভের টাকা দিয়ে ঝিনুকের নামে একটি বৃদ্ধাশ্রম করে সেখানে প্রায় পঞ্চাশজন গরীব-অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ঠাঁই দিয়েছে। এখনও হুইল চেয়ারে ভর করে ফ্যাক্টরি ঘুরে-ঘুরে দেখে কাজের তদারকি করে অমিত। ফ্যাক্টরির তদারকির পাশাপাশি পত্রিকার চাকরি ঠিক রেখেছে নিজের খরচের জন্য। ঝিনুকের গুলশানের বাড়িটিতেই থাকে সে ঝিনুকের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। মনে-মনে ভাবে, ঝিনুক ফিরে এলে সবকিছু তাকে বুঝিয়ে দিয়ে তবেই না তার নিস্তার। এর আগে সে কিছুতেই ভারমুক্ত হতে পারবে না।

অমিতের বয়স এখন সাতান্ন বছর। মাথার সব চুল পেকে গেছে। মুখভর্তি দাঁড়ি তার। কুড়ি বছর আগের অমিতের সঙ্গে এই অমিতের কোনো মিল নেই। ঝিনুকও চিনতে পারবে বলে মনে করে না অমিত। এই কুড়ি বছরে সে একবাও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার চেষ্টা করেনি। ঝিনুকের চিঠি পাওয়ার পর গোসল করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই হেসে ওঠে সে। মনে মনে বলে, ফিরে এসো সুরঞ্জনা, ফিরে এসো এই বুকে আমার। আমি তোমাকে যতেœ রাখব। বিশ্বাস করো, তুমি ছাড়া আমার আর কোনো স্মৃতি নেই। কিশোরী অনামিকা? না, সে আজ আর তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, মৃত মানুষের সঙ্গে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে না। অনামিকা তোমাকে জিতিয়ে দিয়ে গেছে চলে গেছে।

সকাল আটটায় অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা প্রথম ফ্লাইট ল্যান্ড করবে ঢাকা এয়ারপোর্টে। অমিত সাড়ে ছটার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে যায় এয়ারপোর্টে। এতদিন সে ঝিনুকের গাড়িটি ব্যবহার করেনি। যে ড্রাইভার ছিল, তাকে বৃদ্ধ্রাশ্রমের চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে ডেকে এনে অমিত যখন বলল, চলো এয়ারপোর্টে যাব। ড্রাইভার তখন হাঁ করে অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, স্যার কি বিদেশ চলে যাচ্ছেন? অমিত হেসে বলে, না তোমার ঝিনুক ম্যাডাম ফিরে আসছে। ড্রাইভার আনন্দে কেঁদে ফেলে। তার কান্না দেখে অমিতের দুই চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। 

মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে অমিত। সকাল সাড়ে ছটায় স্ক্রিনে দেখল ভিয়েনা থেকে আসা টার্কিস এয়ারলাইনের বিমান নিরাপদে ল্যান্ড করল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর যাত্রীরা ইমিগ্রেশন চেকআপ থেকে বেরিয়ে আসছে। অমিতের তীক্ষè দৃষ্টি সেদিকে। হঠাৎ বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে অমিতের। নীল রংয়ের একটি শাড়ি পরে ঝিনুক বের হয়ে আসছে। ঝিনুক একটুও বদলায়নি, একটুও না। অমিত তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। ঝিনুকের চোখ অমিতকে খুঁজছে অস্থিরভাবে।

রেলিংয়েল এপাশে অমিত। ওপাশে ঝিনুক। ধীর পায়ে এগুতে-এগুতে হঠাৎ ঝিনুকের দৃষ্টি অমিতের চোখে পড়ল। গেট থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমিতের বুকে। অঝরে কাঁদছে ঝিনুক। অমিত সান্ত¦না দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু একবার বলল, আই লাভ ইউ নীলাঞ্জনা। হঠাৎ তাদের ওপর পুষ্পবৃষ্টি পড়তে দেখে দুজনেই অবাক হলো। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অনিমেষ। হাতে ফুলের তোড়া।


রচনা কাল : জুন, ২০২৩

শেষ 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url