তৃতীয় পক্ষ [পর্ব ১]

 

এক

উনিশ’ একাত্তর সালের এপ্রিল মাস। নিছার চৌধুরী দুপুরের দিকে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কাচারিঘরের সামনে প্রকা- একটি আম গাছের ছায়ায় বসেছিলেন তিনি। এ সময় তিনি তার জীবনের পঞ্চাশ বছরের কথা ভাবছিলেন। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কখনও বিষর্ম আবার কখনও সুখানুভূতির সাগরে সাঁতার কাটছিলেন তিনি। 

হঠাৎ একটা দাঁড়কাক মাথার ঠিক ওপরে বসে ‘কা-কা’ করে ডেকে উঠলো। কয়েকটি গুটি আম টুপ্ করে ঝরে পড়লো। নিছার চৌধুরী চোখ মেলে তাকালেন। ইচ্ছে হলো ‘অলক্ষ্মী’ দাঁড়কাকটাকে একনজর দেখবেন। অথচ পাতার আড়ালে কাকটাকে খুঁজে পেলেন না তিনি।

নিছার চৌধুরীর হঠাৎ বড় ছেলের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো বড় ছেলে মহিউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সুন্দরবন গেছে। এ পর্যন্ত তার কোন সংবাদ না পেয়ে ভিতরে ভিতরে খুবই আতঙ্কিত হলেন তিনি। এ কারণে কিছুটা চিন্তিত ও বিষর্ম হয়ে পড়েছেন নিছার চৌধুরী।

হাত বাড়িয়ে পিতলের তৈরি হুঁকোটা টেনে নিয়ে বার দুয়েক টান দিলেন তিনি। হুঁকোটা গুড় গুড় শব্দ করলো, ধোঁয়া ছাড়ল না। বিরক্ত হলেন নিছার চৌধুরী। নিবে যাওয়া কলকির দিকে তাকিয়ে কাজের ছেলে জবেদ আলীকে ডাকলেন।

ছেলেটির কোন সাড়া-শব্দ পেলেন না তিনি। আবার গলা চড়িয়ে ডাকতেই জবেদ আলী কাঁচুমাচু করে চৌধুরী সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো। নিছার চৌধুরী জবেদ আলীকে ইঙ্গিতে কলকিতে তামাক ও আগুন দিতে বললেন। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে হুঁকো থেকে কলকিটা খুলে নিয়ে চলে গেল ছেলেটি।

জবেদ আলীর বয়স বারো-তেরো। কথা বলতে পারে না। কানে শোনে খুবই অল্প। একমাত্র খালা ছাড়া ওর আর কেউ নেই এ সংসারে। খালার কাছেই এতোদিন ওর আশ্রয় ছিল। সম্প্রতি নিছার চৌধুরীর মেজো ছেলে শিহাবউদ্দিন স্কুলে যাবার পথে জবেদ আলীকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে বাসায় নিয়ে এসেছে। শিহাবের বয়সও ওর মত। সমাজের ধনী-গরীবের পার্থক্য শিহাব কিংবা জবেদ আলী এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। সুতরাং, কয়েক দিনের মধ্যেই ওরা দুজন ভালো বন্ধু হয়ে গেল।

জবেদ আলী ফুঁ দিতে দিতে হুঁকোর মাথায় কলকি বসিয়ে পাইপটা নিছার চৌধুরীর হাত ধরিয়ে দিল। চৌধুরী সাহেব একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে হুঁকোর গুড় গুড় শব্দে বিভোর হলেন, চোখ বন্ধ করলেন তিনি। কী যেন ভাবতে লাগলেন আপন মনে।

হঠাৎ মিলিটারী বুটের গট্ গট্ শব্দে চোখ মেলে তাকালেন নিছার চৌধুরী। দেখলেন কয়েকজন রাজাকার তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের মধ্যে বজলু রাজাকারও রয়েছে। বজলু এক সময় সিঁদকাটা চোর ছিলো, ডাকাত দলের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিলো ওর। পুলিশ মাঝে মধ্যে বজলুকে থানায় ধরে নিয়ে বেধড়ক পেটাতো। মাঝে মধ্যে ছ’মাস-একবছর জেল খাটতে হতো বজলুকে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বজলু আবার তার পুরানো পেশায় ফিরে যেতো। সেই বজলু এখন রাজাকারের কমা-ার! লোকজনের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, লুটপাট ও ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ বজলু রাজাকার খুব ঠা-া মাথায় করতে পারে।

বজলু রাজাকার নিছার চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ওসি সাহেব আপনাকে সালাম জানিয়েছেন।

এ কথায় অন্য দশজনের মতো নিছার চৌধুরীর ভয় পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ভয় পেলেন না তিনি। ছোটবেলা থেকে তার চরিত্রে ভয়ের কোন স্থান নেই। সৌখিন শিকারী নিছার চৌধুরী সুন্দরবনে বহুবার বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন। বাঘের চোখে চোখ রেখে বন্দুকের ট্রিগারে আঙ্গুল চালাতে কখনোই বুক কাঁপেনি তার। 

ওসি সাহেবের সালামে তিনি একেবারেই নির্বিকার রইলেন। ভয়ের লেশমাত্র তার চেহারায় দেখা গেলো না। তিনি অত্যন্ত নিরুদ্বিগ্নভাবে হুঁকো টানতে লাগলেন। রাজাকার তিনজনের কেউ আর কোন কথা বলতে সাহস করলো না। 

‘কখন যেতে হবে থানায়?’

নিছার চৌধুরী বজলু রাজাকারকে জিজ্ঞেস করলেন।

বজলু বলল, আমাদের সঙ্গেই যেতে বলেছেন।

নিছার চৌধুরী নলটা হুঁকোর সঙ্গে পেঁচিয়ে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলো।

কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা পাঞ্জাবীর এক প্রান্তে মুছে চোখে লাগালেন নিছার চৌধুরী। রাজাকার তিনজনকে পেছনে রেখে হাঁটতে লাগলেন থানার উদ্দেশে।

এ দৃশ্য প্রতিবেশীদের অনেকেই দেখলো। কেউ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, কেউবা জানালার ফাঁক দিয়ে। যারা এ দৃশ্য দেখলো তারা কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে আতঙ্কের কথা চালাচালি করলো। নিছার চৌধুরীর ভবিষ্যৎ নিয়েও শংকিত হলো অনেকেই। কিন্তু নিছার চৌধুরী এতোটুকু শংকিত কিংবা আতঙ্কিত হলেন না।

এ সময় প্রতিবেশী জয়নাল বেপারী হন্তদন্ত হয়ে নিছার চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। জয়নাল পিস কমিটির সদস্য। চৌধুরী সাহেবের দূর সম্পর্কের ভাই। বয়সে প্রায় দশ বছরের ছোটো। তার ঘরের সামনে নামফলকে লেখা রয়েছে ‘জয়নাল বেপারী, চেয়ারম্যান, থানা পিস কমিটি’। 

নিছার চৌধুরী জয়নাল বেপারীর ঘরের সামনে লটকানো নামফলকের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। দৃষ্টি এড়ালো না জয়নাল বেপারীর।

‘কী হয়েছে ভাইজান, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

জয়নাল অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে প্রশ্ন করল।

বজলু রাজাকার বললো, থানায়। ওসি সাহেব সালাম জানিয়েছেন।

নিছার চৌধুরী বজলু রাজাকারকে ধমক দিলো। অপ্রত্যাশিত ধমকে বজলু বেলুনের মতো চুপসে গেলো।

নিছার চৌধুরী মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে একপলক জয়নাল বেপারীর চোখের দিকে তাকিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। একপলক চোখের দৃষ্টিতে মুহূর্তের জন্য দগ্ধ হলো জয়নাল বেপারী। তারপর অমসৃণ হাসি হেসে ঘরের দিকে পা বাড়াল সে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url