একজন অনিন্দ্য

 

গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা এক যুবক অনিন্দ্য। অনিন্দ্যর গোপন কিছু দুঃখবোধ আছে। সব মানুষেরই যেমন থাকে। কারও বড়লোক না হওয়া, গাড়ি-বাড়ি না থাকা, আবার কারও কারও সন্তান না হওয়ার দুঃখ খুবই সাধারণ আজকাল। জীবনের প্রতিটি যোগফল মিলে যাওয়ার লোক খুব কমই আছে এ জগৎ-সংসারে। এই বিরাট পৃথিবীতে কষ্ট নেইÑএমন মানুষ হয়তো পাওয়াই যাবে না! তাহলে অনিন্দ্যর কেন দুঃখ থাকবে না! সে তো অন্য পাঁচজনের মতোই। অসাধারণ কেউ নয়! তারপরও অনিন্দ্যর দুঃখটা কেন যেন একটু আলাদা । পড়ন্ত বিকেলে এবং সন্ধ্যায় এমন করেই ভাবে অনিন্দ্য। ওর এই ভাবনা চিরন্তন।

মফস্বল শহরের মধ্যবিত্তের সংসার ছেড়ে অনিন্দ্য যখন ঢাকায় আসে তখন বুড়িগঙ্গা বিষাক্ত ছিল না। ঢাকা তখন ব্যস্ত নগরী ছিল না। এত এত দালান-কোঠায় ঠাসাঠাসি ছিল না এ নগরী। জহুরুল ইসলামের বাইশ তলা নাভানা বিল্ডিং আর ডিআইটির ঘড়ি ছাড়া হাইকোর্টের মাজার ছিল মানুষের কৌতূহলের বিষয়। রমনা পার্কে মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য খুঁজে বেড়াতো। যদিও ঢাকার রাজপথগুলো ছিল বৃক্ষশোভিত। মানিক মিয়া এভিন্যুর প্রশস্ত রাস্তা এমন ছিল না তখন। আসাদ গেট পর্যন্ত রাস্তাটি পরিপূর্ণ ছিল গাছে গাছে। চৈত্রের তাপ থেকে বাঁচতে মানুষ সেসব গাছের নীচে আশ্রয় নিতো। টুংটাং রিকশা চলতো, বাস চলাচল শুরু হয়নি তখনও এ রাস্তায়। সন্ধ্যায় নিয়নের আলো-আঁধারীতে গা-ছমছম পরিবেশ ছিল মানিক মিয়া এভিন্যুর। অনিন্দ্য তখন এ রাস্তায় হেঁটে বেড়াতো একা একা- আনমনে।

মফস্বল শহরের ছেলে বলে শহরে তখনও অনিন্দ্যর বন্ধু জোটেনি তেমন একটা। বন্ধুত্ব করার কিছুই ছিল না তার। কলেজ জীবনের বন্ধুরা যখন বেলবটম পরতো, টু-ইন ওয়ানের গানের ক্যাসেট হাতে অহংকারে রাজহাঁসের মতো গ্রীবা উঁচু করে সিগারেট ফুঁকতো, অনিন্দ্য তখন একেবারেই সাদামাটা গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন। অনিন্দ্য অনেক জামাকাপড় নেই, একটিমাত্র প্যান্ট, জুতো জোড়া ছেড়া বললেই চলে।  অনিন্দ্যর হাতে তখন একটা ঘড়িও নেই। ঘড়ি পরার খুব ইচ্ছে ছিল অনিন্দ্যর। গ্রামের রংচটা তারুণ্য নিয়ে শহরের উজ্জ্বল আলোতে খেই হারিয়ে ফেলা অনিন্দ্য মানিক মিয়ার এভিন্যুর রাস্তায় একা একা হেঁটে বেড়াতো আর ফেলে আসা দিন, ছোট ছোট আরও কয়েকটি ভাইবোনের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলে অজান্তেই চোখ জলছলছল করতো তার। বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত। কেউ তা জানতো না। বাবা-মা মনে করতেন শহরে মেয়েজামাইয়ের বাসায় ভালোই আছে অনিন্দ্য। কিন্তু অনিন্দ্য কখনোই ভালো ছিল না। বড়লোক ভগ্নিপতির বাসায় আশ্রয়ে থেকে রেশন তোলা, বাজার করা আর ফুটফরমাস খাটার পর কলেজে যাওয়ার সময় পার হয়ে যেতো প্রায়ই। গোরানবাজার থেকে এক ঘন্টার রাস্তা পায়ে হেঁটে মালিবাগ মোড়ে পৌঁছে গুলশানগামী ছয় নম্বার বাসে বাদুরঝোলা হয়ে কলেজে পৌঁছানো সহজ কথা নয়। তবু অনিন্দ্য চেষ্টা করত বাসের একটু জায়গা করে নেয়ার জন্যে। কতদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কতবার ছিঁটকে পড়েছে, সে কথা আজও মনে পড়ে তার।

অনিন্দ্যর কোনো পড়ার টেবিল ছিল না। বইগুলো ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকতো এখানে-ওখানে। অনিন্দ্যর ছোট দু’টি ভাগ্নে-ভাগ্নি বইয়ের পাতা ছিঁড়ে নৌকো বানাতো। মামা বলে কিছুই বলতে পারতো না এসবের জন্য। কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত খোলা বারান্দায় স্টিলের একটি চেয়ারে বসে হাঁটুর ওপর হিসাব বিজ্ঞানের মোটা বই খুলে অংক কষতো অনিন্দ্য। রাতে ষাট ওয়াটের ম্লান আলোয় পড়ার সুযোগ খুঁজতো মশার কামড়ে অতীষ্ঠ হয়ে। মনের জানালায় ভেসে উঠতো অতীত দিনের সুন্দর দিনগুলো।

দীর্ঘদিন মানসিক অশান্তিতে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল অনিন্দ্য। স্বস্তি খুঁজতে একদিন কিছু বইপত্রসহ বাসা থেকে বের হয়ে পড়ল। বড়ো ভাই তখন মোহাম্মদপুরে থাকে, সেও বেকার। ভাইয়ের মেসে গিয়ে উঠল অনিন্দ্য। কেন ভগ্নিপতির বাসা ছেড়ে এসেছে অনিন্দ্য সে ব্যাপারে একটি কথাও জিজ্ঞেস করলো না বড়ো ভাই। মেসে সবার সঙ্গে মাসখানেক কাটিয়ে পরীক্ষার আগে ঢাকা কলেজে ডিগ্রি হোস্টেলে উঠল সে। সিটি কলেজে পরীক্ষা কেন্দ্র হওয়ায় ভালোই হলো অনিন্দ্যর, রিকশা ভাড়া লাগত না। লাগলে পায়ে হেঁটেই যেতে হতো তাকে। পড়াশুনার খুব একটা ধারধারত না অনিন্দ্য। পরীক্ষা চলা অবস্থায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অডিটোরিয়ামে গিয়ে রাত দশটা পর্যন্ত টিভি দেখে হলে ফিরত অনিন্দ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করা এক সিনিয়র ভাই অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করেছিল, অনিন্দ্য পরীক্ষায় পাস করবে কি না। অনিন্দ্য হেসে উত্তর দিয়েছিল না, করার কী আছে! সিনিয়র বলেছিল, আপনার মতো নিরুদ্বিগ্ন পরীক্ষার্থী জীবনে দেখিনি তো, তাই বললাম। আপনি যদি পাস করেন তাহলে আমাকে জানাবেন কিন্তু। অনিন্দ্য পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে সিনিয়র ভাইর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল যে অনিন্দ্য এখন ঢাবির ছাত্র।

আজকাল সন্ধ্যাবেলায় লেখালেখির টেবিলে ল্যাপটপের সুইচ অন করতেই পুরনো কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অনিন্দ্যর। কম্পিউটার স্ক্রিনে ঘড়ির কাঁটা ত্রিশূলের মতো বাজে বুকে। পাশেই দামী হাতঘড়ির দিকে তাকায় ঝাপসা দৃষ্টিতে। কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে তার। একবার একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে, ‘ক’টা বাজে অনিন্দ্য?’  অনিন্দ্য তখন আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। মেঘে ঢাকা সূর্যকে দেখতে না পেয়ে আন্দাজ করতে পারেনি সময়টা কত হতে পারে। এসব এখন খুব পুরনো স্মৃতি। কিন্তু কষ্টটা খুব টাটকা। শীতের সকালে সবজির মতো। বিন্দু বিন্দু শিশির কণার মতো উজ্জ্বল।

একদিন বড় ভাইয়ের হাতে একটি নতুন ঘড়ি দেখে পছন্দ হয়েছিল অনিন্দ্যর। অনিন্দ্য সে কথা ভাইকে জানিয়েছিল মায়ের মুখ দিয়ে। কথাও দিয়েছিল ভাই। কিন্তু হঠাৎ তাস খেলতে গিয়ে ঘড়িটা বন্ধক রাখে ভাইয়া। অনিন্দ্য বন্ধুদের কাছ থেকে পাঁচশ’ টাকা ধার করে সখের ঘড়িটা ছাড়িয়ে ভাইয়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল। মনে মনে ভাবছিল বড় ভাই ঘড়িটা নিশ্চয়ই তাকে দেবে।  তবে দেয়নি। কিছুদিন পরে ঘড়িটা পেয়েছিল অনিন্দ্যর ভাবীর বড় ভাই! তারপর অনিন্দ্য সে ঘড়ির দিকে ফিরেও তাকায়নি কখনও। সেই থেকে অনিন্দ্যর ঘড়ির প্রতি মারাত্মক দুর্বলতা তার। এখন তার বেশ কয়েকটা ঘড়ি। দামী-কম দামী সবই আছে। তবে ভাইয়ের হাতের ওই ঘড়িটির মতো দামী মনে হয় না সেগুলোকে কখনও!

সারাটা দিন যেভাবেই কাটুক, রাতে ঘুমানোর একটা জায়গা খুব দরকার প্রতিটি প্রাণীরই। মানুষের জন্য নিরাপত্তা একটু জটিল। মাথাগোঁজার ঠাঁই চাই, আশ্রয় চাই, অন্তত রাতের বেলা।  নদীভাঙা মানুষ জীর্ণ বস্তি এবং ফুটপাতে ঘুমায়। পাকা দালানে বাস করেও অনিন্দ্যর ঘুমানোর জায়গা ছিল না। তবে তিনদিক খোলা বারান্দায় পাতলা একটি তোষক আর একটি বালিশ ছিল অনিন্দ্যর। রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় থাকতে হতো তাকে। চারদিকের বাতিগুলো নিবে গেলে অনিন্দ্য বিছানা পাততো খোলা বারান্দায়। গরমের দিনগুলোতে খোলা জায়গায় খারাপ কাটতো না তার। তারপরও মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাতলা কাঁথা মুড়ি দিয়ে রাতটা পার করতে হতো তাকে। শীতের দিনগুলোতে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতো অনিন্দ্যর। সকালের সূর্যের অপেক্ষায় থাকতো সে।

বর্ষা অনিন্দ্যর খুব পছন্দের। তবে গ্রাম ছাড়ার পর শহরের বর্ষা অনিন্দ্যকে কষ্ট দিয়েছে খুব। রাতে বৃষ্টি শুরু হলে বিছানাপত্তর গুছিয়ে দেয়ালে পিঠ  ঠেকিয়ে বসে থাকতো হতো। মাঝে মাঝে বাড়িওয়ালার কুকুরটিকে কাছে পেতো অনিন্দ্য। কুকুরটি কাছে পেলে ভয় কেটে  যেতো তার।

বর্ষফাইনাল পরীক্ষার সময় মা এলেন মেয়ের বাসায় বেড়াতে। শীতের মধ্যে খোলা বারান্দায় অনিন্দ্যকে পড়তে দেখে মা কষ্ট পেলেন। বললেন, ‘এবার বাড়িতে চল বাবা। বাসার পাশেই তো কলেজ আছে।’ অনিন্দ্য উত্তর দেয়নি মায়ের কথার। একদিন রাত দশটার দিকে অনিন্দ্য বারান্দায় বসে পড়ছিল, হঠাৎ অনিন্দ্যর ভগ্নিপতির নির্দেশ এলো বারান্দার লাইট না নেভালে জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়! অনিন্দ্য বাধ্য হয় লাইট বন্ধ করতে। অনিন্দ্যর মা বুঝতে পারলেন তার ছেলের কষ্টের কথা। নীরবে চোখ মুছলেন মা। অনিন্দ্যর দৃষ্টি এড়াতে পারলেন তিনি। এক সময় অনিন্দ্যর কষ্টের বোঝা ভারি হতে লাগলো। পালাতে মন চাইলো। পালিয়ে গেলো সে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অনিন্দ্যর হল জীবনে বেশ কয়েকজন বন্ধু জুটে গেলো। এনায়েত, কবির, আমজাদ, ফেরদৌসী আর শিরিনদের সঙ্গে আড্ডা জমতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, টিএসসি’র কড়িডোরে। ফেরদৌসী প্রায়ই রবি ঠাকুরের ‘কেটেছে একেলা বিরহেরই বেলা’ গানটি গাইতো উদ্যানে বসে। সেই ফেরদৌসীকে কবির নীরবে ভালোসতো। একদিন কবির জানতে পারে আনন্দমোহন কলেজের এ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন ফেরদৌসীর বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। কষ্টে দেশ ছেড়ে পালালো কবির। 

হলে প্রায়ই না খেয়ে থাকত অনিন্দ্য। মাস শেষ হওয়ার আগেই বাবার পাঠানো টাকা ফুরিয়ে যেত। বাবা কখনোই ঠিক মতো টাকা পাঠাতে পারতেন না। এ মাসে পাঠালে পরের মাসে পাঠাতেন না।  বাবার কাছ থেকে টাকা না পেয়ে অনিন্দ্য একদিন সড়ক ভবনে চাচার কাছে একশ টাকা  চেয়ে বলেছিল, বাবা টাকা পাঠালেই দিয়ে দেবে বলে। চাচা তো টাকা দেনইনি, বরং অনিন্দ্য পকেটে থাকা বারো টাকা থেকে আট টাকা খরচ করিয়ে ডিগ্রি পরীক্ষার সাজেশন কিনে নিয়েছিলেন। প্রচন্ড রোদে সড়ক ভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে ঢাবির রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে সাজেশন কিনে দিয়েছিল অনিন্দ্য। পানি তৃষ্ণা ও ক্ষুধায় কাতর হয়ে ভাবছিল চাচা হয়তো চা সিঙ্গারা খাওয়াবেন। খাওয়ালেন না। অনিন্দ্য টাকার কথা বললে তিনি বলেছিলেন যে, তার কাছে টাকা নেই! অথচ অনিন্দ্য চাচার গোল্্ডলিফ শার্টের পকেটি একশ টাকার নোট দেখেছিল। অনিন্দ্য একপর্যায়ে সড়ক ভবনের কেন্টিকে এক টাকা খরচ করে চা-সিঙ্গারা খেয়ে হলে ফিরেছিল। এসব কথা অনিন্দ্যকে খুব কষ্ট দেয় আজকাল।  

অনিন্দ্যর মন ছটফট করতো বাড়িতে যাওয়ার জন্য। গ্রামের বাড়িতে শমির সঙ্গে অনিন্দ্যর জটিল একটি সম্পর্ক ছিল। অনিন্দ্য শমিকে চিঠি দিয়েছিল গোটা দুই।  উত্তর পায়নি কিছু। তারপর কিছুদিন পর অনিন্দ্য ঢাকায় চলে আসে।  

সেই শমিরও  হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেলো একদিন!  বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটির অবসরে বাড়িতে গেলে অনিন্দ্যকে খবরটা দিয়েছিল ছোটবোন নয়না। ওর ধমনীতে তখন রক্তের শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মুখে অনিন্দ্য তাকালো সূর্যের দিকে।  মেঘলা আকাশে সূর্যকে খুঁজে পেলো না সে। তারপর ত্রিশ বছর ধরে  আরও একবার শমির সঙ্গেও দেখা হওয়ার প্রতীক্ষায় আছে অনিন্দ্য। কষ্টের দিনগুলো এখন আর কিছুতেই পিছু ছাড়ে না ওর। অনিন্দ্য কষ্টের বাগানে প্রজাপতিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এখন। 

২৯ অক্টোবর, ২০১১, বাসস
গল্পটি শুনতে পাবেন : 
https://www.youtube.com/@dhansiri2024


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url