বই পড়ব কেন, কী তার উপকারিতা?


সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানুষের বই পড়ার অভ্যাস আস্তে আস্তে কমে এসেছে। এর কারণ সঠিক কী, কেন বই পড়ছে না মানুষ আগের মতো, তার সঠিক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তবে অনেকেই বলে থাকেন সময় নেই বলে, অর্থাৎ প্রতিদিনের কাজকর্মে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয় যে, বই পড়ার আর সময় হয়ে ওঠে না। সত্যিই কি? তাহলে কয়েকটি বিখ্যাত লোকদের সামান্য কিছু উদাহরণ দিচ্ছি, যারা প্রচুর কাজের মধ্যেও নিয়মিত বই পাঠ করছেন।  এই উদাহরণের পর আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব, বই পড়লে আমাদের কী কী উপকার হতে পারে, অর্থাৎ বই পড়া কেন দরকার আমাদের।

জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে যেসব গুণাবলি বা দক্ষতার প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বই পড়া বা বই থেকে জ্ঞান অর্জন। পৃথিবীর সফলতম মানুষদের মধ্যে জ্ঞান এর প্রতি যে অসীম তৃষ্ণা রয়েছে তা মেটানোর জন্যই হচ্ছে বই পড়া। Warren Buffett তাঁর পেশা জীবনের শুরুতে প্রতিদিন ৬০০-১০০০ পৃষ্ঠা নিয়মিত পড়তেন! Bill Gates প্রতিবছর ৫০টি বই শেষ করেন। Elon Mask রকেট সায়েন্স এর বিদ্যা বই পড়ার মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। Mark Cuban প্রতিদিন ৩ ঘণ্টার বেশি বই পড়েন।

এসব পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, তারা সফল হওয়া সত্ত্বেও তাদের জানার প্রতি রয়েছে অসীম আগ্রহ। তাই তাদের কাছে বই পড়ার গুরুত্ব কমে যায় নি। কারণ তারা জানেন বই পড়েই হওয়া যায় সুদক্ষ এবং অনেক গুণাবলীসম্পন্ন। আসুন দেখে নিই কীভাবে আমাদের বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে বই।

‘বই’ দুই বর্ণের একটি শব্দ মাত্র। যা এসেছে আরবি ‘ওহি’ থেকে। আরবি ‘ওয়াও’ হরফের বাংলা উচ্চারণ হয় ‘ব’। ওহির বাংলা উচ্চারণ হয় বহি। ধীরে ধীরে ভাষার পরিবর্তনে বহিটি বই রূপ ধারণ করেছে। এভাবে বইয়ের সঙ্গে ঐশী জ্ঞানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বই পড়লে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার সিঁড়ি হচ্ছে বই। 

 মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিস্ফোরণ একমাত্র বইয়ের মাধ্যমে হতে পারে। আসুন দেখে নেওয়া যাক বই পড়লে কী কী উপকার হতে পারে আমাদের।

১. বই পড়লে  মানসিক উত্তেজনা কমে

বই  পড়লে মানসিক উত্তেজনা কমে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধ্যয়ন Dementia এবং Alzheimer’s নামের  এই রোগ দুটিকে হ্রাস এমনকি প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। মস্তিষ্ককে সচল রাখলে তা কখনোই তার ক্ষমতা হারাবে না। মস্তিষ্ককে শরীরের একটি সাধারণ পেশী হিসেবে বিবেচনা করে, নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা শক্তিশালী এবং ফিট থাকবে।

২. মানসিক চাপ হ্রাস পায়

কিছু মানুষ তাদের মানসিক চাপ কমাতে ব্যায়ামের আশ্রয় নেয়, কেউ কেউ আবার যোগব্যায়ামের দ্বারস্থ হয় তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে। জীবনে এমন কোনো মানসিক চাপ নেই সেটি যেই পরিমাণই হোক না কেন, যা একটি ভালো গল্প সমাধান করতে পারে না। বই পড়ার মজা হচ্ছে এটি একজন মানুষকে মুহূর্তের মধ্যেই কোনো এক অজানা জগতে নিয়ে যাবে কিংবা এমন কোনো সময়ে ভ্রমণ করাবে যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। একটি ভালো অনুচ্ছেদ তাকে প্রতিদিনের বাস্তবতা থেকে একটু হলেও রেহাই দেবে। এমনি মানসিক চাপ কমিয়ে মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনে সহায়ক মাধ্যম বই।

৩. শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধি পায়

যত বেশি বই পড়া হবে তত বেশি শব্দভাণ্ডারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ যোগ হতে থাকবে। ফলে বই পড়া শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধিতে অনেক বেশি সাহায্য করে। নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা চাকুরিজীবনে এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও সহায়ক হবে। এমনকি  একজন মানুষকে আত্মবিশ্বাস জোগাতেও অনেক সাহায্য করে। নতুন কোনো ভাষা শিখতেও বই পড়ার বিকল্প নেই। এটি খুব দ্রুত নতুন যেকোনো ভাষাকে আয়ত্ত করতে সহায়তা করে।

৪. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়

কটি বই পড়ার সময় দেখা যায় বিভিন্ন তথ্য দেয়া থাকে যা পাঠককে গল্পের স্বার্থেই মনে রাখতে হয়। যেমন: বিভিন্ন চরিত্র, ইতিহাস, পটভূমি, গল্পের উদ্দেশ্য, উপ-খণ্ড ইত্যাদি। এসব তথ্য আমাদের কাছে অতিরিক্ত মনে হলেও মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে সবকিছু মনে রাখার। প্রত্যেকটি নতুন স্মৃতি একটি নতুন Synapse তৈরি করে এবং বিদ্যমান স্মৃতিকে আরও শক্তিশালী করে এবং স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিকে আরও উন্নত করে।


৫. বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা (Analytical thinking)-কে উন্নত করে

বই পড়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা  ( Analytical thinking)-কে উন্নত করা। অনেকের কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় Analytical thinking খুব দরকার পড়ে, সেই ক্ষেত্রে বই পড়া খুব কাজে লাগতে পারে। এমনকি কখনো হয়েছে যে পাঠক কোনো রহস্যমূলক বই পড়ার সময় পুরো বই পড়ার আগেই রহস্যটি সমাধান করে ফেলেছেন? তার মানে তার ভালো দক্ষতা রয়েছে। মানুষের জীবনেও এমন অনেক পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে Analytical thinking দিয়েই সেসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়।

৬. অন্যের আহরিত জ্ঞান থেকে অভিজ্ঞতা নেয়া

পাঠক যে বইটি পড়ছেন সেটি মূলত সেটি ওই বইয়ের লেখকের বিশেষ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা। সেই জ্ঞান পাঠকের সফলতাকে ত্বরান্বিত করবে। বিভিন্ন বইয়ে দেখা যায় লেখক তার জীবনের সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করে এবং সেই ব্যর্থতা থেকে কীভাবে কী উপায়ে তিনি উপরে উঠতে থাকে সেই বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ থাকে ওই বইয়ে। সেই লেখা বা গল্প থেকে জানতে পারা যায় কোন পথে গেলে সফলতা নিশ্চিত এবং ভুলের সম্ভাবনাও কমে আসে। জীবন খুবই ছোট এসব ভুলের পুনরাবৃত্তি করা সফলদের একজন হতে চাইলে তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নাও এবং জেনে নাও ব্যর্থতাকে সফলতায় রূপান্তর করার মন্ত্র ।

৭. কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়ায়

বই যেন মানুষকে এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাবে, তাকে দেখাবে কোনো কিছুই যেন অসম্ভব নয়। পড়ার মাধ্যমেই দেখাবে বিষয়গুলোর অধিকাংশ তার জানা। বাকিটা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সহজেই আবিষ্কার করা সম্ভব। বই যেন এক বিশাল মাকড়শার জাল, যা সবকিছুকেই এক সূত্রে গেঁথে দেয়, পাঠকের জানা বিষয়ের সঙ্গে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়কে জোড়া লাগিয়ে নতুন এক উত্তর কিংবা সমাধান বের করা যেন বইয়ের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

৮. নতুন চিন্তা বা আবিষ্কার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

বই পড়ার মাধ্যমে একজন মানুষ নতুন বিষয় বা তথ্য উদঘাটনে সহায়তা পান। কোন সমস্যা সমাধান করা অথবা কোনো কিছু অর্জন করার নতুন কোনো মাধ্যম আবিষ্কার করতে বই ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বই পড়ার সুবাদে তার পছন্দের তালিকায় নতুন কোনো শখ কিংবা নতুন কোনো পেশা যুক্ত হয়েছে যেটি শেষে সে তার পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং সফলতা অর্জন করেছে। অন্বেষণের শুরু কিন্তু পড়া এবং উপলব্ধির মাধ্যমেই।

৯. আত্মার জন্য ধ্যান (Meditation for soul) 

মানসিক প্রশান্তি পেতে কোনো এক নিরিবিলি জায়গায় কোনো এক পছন্দের বই নিয়ে যেতে হবে। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মুক্ত বাতাস ওই পাঠকের চিন্তাকে যেন আরও প্রসারিত করবে, যা কখনোই লাইব্রেরিতে বসে বসে পড়ার মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের বই পড়া তার সারাদিনের ক্লান্তিকে নিমিষেই দূর করে দিবে।

১০. মনোযোগ বৃদ্ধি করে

যখন আমরা একটা গল্প পড়ি তখন আমাদের মনোযোগ শুধুমাত্র সেই গল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, যেন পুরো পৃথিবীটা তখন নিশ্চুপ হয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন যদি বই পড়ার অভ্যাস করা হয় তবে দেখবে মনোযোগ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজে যাওয়ার আগে ১৫-২০ মিনিট পড়ার অভ্যাস করলেএবং দেখা যাবে আগের থেকেও অনেক বেশি মনোযোগী হওয়া যায়।

“Reading is to the mind, what exercise is to the body” – এই কথাটির মধ্যেই বই পড়ার গুরুত্ব বোঝা যায়। ব্যায়াম যেমন আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি বই পড়ার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মনকে সুস্থ এবং প্রফুল্ল রাখতে পারি। আসলে বই পড়ার আনন্দ কখনোই শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয় এটি শুধু অনুভব করা যায় অভিজ্ঞতা দ্বারা।

নাসির আহমেদ কাবুল
কবি ও গীতিকার
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url