ফিরে এসো নীলাঞ্জনা [৮]


।। আট ।।

গল্প করতে-করতে অনেক রাত হয়ে যায়, আকাশে তখন একাদশীর চাঁদ হেলে পড়েছে। সামনের ফুলের বাগান থেকে হাসনাহেনার মাতাল করা ঘ্রাণ ছুটে আসছে। অমিত বলে, ‘ঘুমাবে না? ঘুম আসছে না তোমার?’

‘না।’

‘কেন?’

‘তুমি কি জানো, এমন একটি রাতের জন্য কতটা বছর অপেক্ষা করেছি?’

‘মানে?’ অবাক হয় অমিত।

‘তোমার সঙ্গে গল্প করার একটি রাতকে কত খুঁজেছি আমি।’

অমিত অস্বস্থি ফিল করে। লক্ষ করে ঝিনুক। তারপর বলে, ‘তুমি শুয়ে পড়তে পারো। আমি উপরে চলে যাচ্ছি। কোনো কিছু দরকার হলে মাথার কাছে ফোন আছে। কল করো। গুডনাইট।’

রুম থেকে ধীরে-ধীরে বের হয়ে যায় ঝিনুক। একবারও পিছন ফিরে তাকায় না। অমিত ঝিনুকের চলে যাওয়া দেখে। হঠাৎ কোথায় যেন একটা টান অনুভব করে সে। 

অনেক রাতে উপরে ধুপধাপ শব্দ হতে থাকে। অমিত প্রথমে চোর-ডাকাত কিছু একটা মনে করেছিল। কিন্তু না। সে রকম শেষ পর্যন্ত মনে হলো না তার। সকালে ঝিনুক ঘুম থেকে ওঠার আগে এক পরিচারিকা বেড-টি নিয়ে এলে অমিত কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করল, ‘রাতে কিছু শব্দ পেয়েছ তুমি?’

পরিচারিকা খুব স্বাভাবিক বলল, ‘ওরকম প্রায়ই হয় স্যার।’

‘প্রায়ই? কিন্তু কেন? কে অমনটা করে?’

‘স্যার এসব কথা ম্যাডাম জানলে আমার চাকরি থাকবে না।’

‘তোমার কথা জানবে না। তুমি বলতে পারো।’

‘স্যার, প্রতিদিন রাতে ম্যাডাম ড্রিংক করেন। যেদিন বেশি পরিমাণ ড্রিংক করেন, সেদিন নিজের রুমে ভাঙচুর করেন। আপনি সেই শব্দই শুনেছিলেন।’ পরিচালিকা আর কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।


সকাল নয়টায় ঝিনুক অমিতের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘চলো ব্্েরকফাস্ট রেডি।’

ঝিনুকের দিকে বিস্ময় নিয়ে থাকায় অমিত। এইমাত্র গোসল করে এসেছে ঝিনুক। পরনের স্যালোয়ার-কামিজ। বাসন্তী রং কামিজের সঙ্গে মেঘরং পাজামা ও ওড়না পড়েছে সে। ঝিনুককে দেখে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘ধানী রং ঘাগরি মেঘ রং ওড়না/পরিতে আমায় মাগো অনুরোধ করো না’ গানটি মনে পড়ে অমিতের। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ভাবতে থাকে এই ঝিনুক রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ভাঙচুর করেছে! কিন্তু কেন? ওকে এই মুহূর্তে দেখলে তো একটুও সে রকম মনে হয় না। কী ওর কষ্ট যে, রাতে মাতাল হতে হবে?’

ঝিনুকের ডাকে ধ্যান কেটে যায় অমিতের। ‘কী দেখছ অমন করে?

অমিত স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে বলে, ‘তোমাকেই তো দেখছিলাম।’

‘আমাকে? উঁহু একটুও না। তুমি কিশোরী প্রেমিকাকে মনে করছিলে? কি সত্য না?’

অমিত অস্বীকার করে বলে, ‘না, একটুও সত্যি না। তোমাকে দেখছিলাম। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

সোফায় বসতে-বসতে ঝিনুক বলে, ‘তুমি আমাকে খুশি করতে চেয়ো না অমিত। তুমি জানো কি না জানি না, প্রেমিক পুরুষের চোখ দেখলে মেয়েরা বুঝতে পারে।’

‘তুমি কি বুঝতে পারো?’ অমিত বলে।

‘পারি অমিত। না পারার কিছু নেই তো! তোমার চোখে আমি নেই। একেবারেই নেই। এটাই তো একমাত্র কষ্ট আমার। জীবনে কত ছেলে প্রোপোজ করেছে। সাড়াও দিয়েছিলাম। ওরা আমার মন চায়নি, দেহটাকে চেয়েছে। ওদের আবদার রাখতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছি আমি, অপবিত্র হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে দেখে আমার মনে হলো, আমি সারাজীবন যাকে খুঁজছিলাম, তাকে পেয়েছি। কিন্তু আমি ভাবতেই পারিনি সে আমার হবে না কোনোদিন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লাম। তুমি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে। তোমার কয়েকজন বন্ধু বলল, তুমি গ্রামের বাড়িতে চলে গেছ। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভেবে-ভেবে দশ বছর কাটিয়ে দিলাম!’

অমিত নিজেকে লুকোতে চেষ্টা করে। জানালার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আজ কিন্তু বৃষ্টি হতে পারে।’

অমিতের কথায় ঝিনুকের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অমিতের চোখে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাকে একটা কথা বলব?’

‘অনুমতি নিয়ে কথা বলতে হবে নাকি?’

‘অনুমতি নয় অমিত। অপ্রাসঙ্গিক বলতে পারো।’

‘আচ্ছা বলো।’

‘তুমি বিয়ে করবে না? আমাদের অফিসে খুব সুন্দর একটি মেয়ে আছে। ওর সঙ্গে তোমাকে খুব মানাবে।’

অমিত বলল, ‘না।’

‘না কেন? কিশোরী প্রেমিকার জন্য? কিন্তু ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। ওর জন্য তুমি কি সারাজীবন একা থাকবে না কি?’

‘আমি না হয় ওর জন্য সারাজীবন একা থাকলাম, কিন্তু তুমি কার জন্য বিয়ে করছ না? এই সময় তোমার পাশে একজন থাকলে তোমার একাকীত্ব কাটত, তোমার সমস্যাগুলো আর সমস্যা থাকত না।’

‘সত্যি বলব?’

‘বলো।’

‘তোমার জন্য। আমি জানি তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। বাসবেও না কোনোদিন। তবুও তোমার জন্য, তোমার জন্যই সারাটি জীবন একা থাকব আমি।’

‘আচ্ছা মনে করো, আমি তোমার অফিসের সুন্দরী মেয়েটিকে বা অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলাম, তখনও?

‘কী তখন?’

‘তখনও কি তুমি বিয়ে করবে না?’

‘না অমিত। কোনোদিনই বিয়ে করব না। প্রেম জীবনে একবারই হয়, সে তুমি আমার চেয়ে কম জানো না। যে কিশোরী মেয়ের সঙ্গে তোমার প্রেমই হয়নি কখনো, তার জন্য তুমি সারাটা জীবন একাকী কাটিয়ে দিতে পারলে আমি কেন তোমার জন্য পারব না? আজ এসব কথা থাক। চলো নাস্তার টেবিলে যাই। শফিক ভাইয়ের সঙ্গে এগারোটায় এপয়েনমেন্ট করা আছে, তুমিই তো বললে!’

ওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমিত বলে, ‘সকাল সাড়ে নটা বেজে গেছে।’

নাস্তার টেবিলে বসে ঝিনুক বলে, ‘শফিক ভাই কী আর করতে পারবেন? সন্ত্রাসীদের কেউ কি মোকাবেলা করতে পারে?’

‘পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে পারছ না কেন? দেখি না কী বলেন।’

‘চলো। গিয়ে দেখি।’ নিস্পৃহভাবে কথাটি বলে ঝিনুক।

‘আমি একটা কথা বলব?’

‘কী?’

‘এই বাড়িটা নিয়েই তো ঝামেলা? এটা বিক্রি করে দাও।’

‘পাগল হলে তুমি! জানো, এই বাড়িটি ঘিরে কত স্মৃতি আমার! এই বাড়িটা ছেড়ে দিলে তো আমি একেবারেই শূন্য হয়ে যাব। এ সম্ভব নয় অমিত। তাতে যদি আমার জীবন যায়, যাবে। এতে আমার কোনো আফসোস নেই, তবে এ বাড়ি আমি বিক্রি করতে পারব না।’

বাড়ির প্রতি ঝিনুকের টান দেখে অমিতের নিজের গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। কতদিন বাড়িতে যায় না সে! বাবা মারা গেলে একবার এবং তারপর বছর কুড়ি পর মা মারা গেলে অমিত কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে গিয়েছিল। বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবাকে মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়েছে। মায়ের মৃত্যুর পর ঢাকা থেকে অতটা দূরে গিয়ে মাকে দেখতে পায়নি অমিত। মা তাকে বারবার শেষ দেখা দেখতে চেয়েও দেখতে পারেনি। মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাড়িতে যাওয়ার পথে বড়ো ভাই বারবার ফোন করে জানতে চেয়েছিল অমিতদের পৌঁছতে আর কতক্ষণ? রাত হয়ে যাচ্ছে। মাকে কবর দিতে হবে বলে তাড়া দিচ্ছিল। অমিতের ছোটো ভাইয়ের কাছে ফোন এসেছিল। ছোটো ভাই অমিতের কাছে জানতে চেয়েছে অপেক্ষা করবে কি না? অমিত বলেছে, না অপেক্ষা করার দরকার নেই। স্মৃতিতে মা জীবিত থাকুন। ছোট ভাইও অমিতের সঙ্গে একমত হয়েছিল।

বাড়িতে পৌঁছতে রাত ৯টা বেজে যায়। ততক্ষণে মাকে কবর দেওয়া হয়েছে। মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অমিত রাতের অন্ধকারে সুরা ইয়াসিন মুখস্ত পড়ে দুই হাত তুলে দোয়া করেছিল। সেসব কথা অমিতের প্রায়ই মনে পড়ে। ঢাকায় চাকরি করার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না অমিতের। কিন্তু সর্বক্ষণ তার জন্মস্থানের কথাটা মনে পড়ে কারণে-অকারণে। আজ ঝিনুকের বাবা-মায়ের স্মৃতিবিজরিত বাড়িটির প্রতি তার আবেগ বুঝতে পারছে অমিত। 

শফিক সাহেব অফিসেই ছিলেন। অমিত রুমে ঢুকে ঝিনুককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে, ‘আপনি কি ঝিনুককে চিনতে পারছেন শফিক ভাই?’

শফিক উত্তর দেওয়ার আগেই ঝিনুক বলে, ‘উনি আমাকে চিনতে পারবেন না। তবে আমি চিনি। আমি কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কে-না চিনতো শফিক ভাইকে!’

কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ শফিক বলে, ‘তোমরা কি বিয়ে করেছ, নাকি ভাবছ এখনও?’

অমিত বলে, ‘না না ওসব কিছু নয়। ভাবছিও না।’

অস্বস্থি বোধ করে ঝিনুক। তারপর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, ‘ও বিয়ে করবে না। কোনোদিনই না। ও আমার বন্ধু, শুধুই বন্ধু।’ 

শফিক বুঝতে পারে এ বিষয়টা নিয়ে বেশি সময় কথা বলা ঠিক নয়, এটা ওদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। 

কথা বলতে-বলতে ঝিনুক নিজের সমস্যাগুলোর কথা বলে বিশেষ করে বাড়ি নিয়ে। সব শুনে শফিক বলে, ‘ঝিনুক তোমাকে না চিনলেও তোমার বাবাকে চিনি আমি। আমি জানি তোমার বাবার নামে একটি লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটা কোথায়?’

‘থানায় জমা দেওয়া আছে।’

‘ফ্যাক্টরিতে কোনো সমস্যা? তোমাকে কি রেগুলার যেতে হয় অফিসে?’

‘না। তবে যেতে হয়। প্রতিদিন যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু...।’

‘দিনের বেলা ওরা কিছু করতে সাহস পাবে না। কাল থেকে তোমার বাড়িতে কয়েকজন আনসার গার্ড হিসেবে থাকবে। থানা যে পিস্তলটা জমা করা আছে, ওটার কাগজপত্র আমাকে দিয়ো। পিস্তলটা তোমার নামে করে দেবো। আগ্নেয়াস্ত্র থাকলে ওরা সাহস পাবে না। অমিত তো আছেই বন্ধু হিসেবে। ভয় নেই তোমার। পুলিশের ওপর বিশ্বাস রেখো। তুমি যখন বাইরে যাবে, তখন সাদা পোশাকের পুলিশ তোমার ওপর নজর রাখবে। এতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে?’

ঝিনুক শফিকের কথায় সম্মতি দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল।

শফিক সাহেবের রুম থেকে বের হতে দুপুর বারোটা বেজে যায়। অমিত বলে দুটার সময় তার ডিউটি। অফিসে যাওয়ার আগে মেসে যেতে হবে একবার। রুমমেট রউফ সাহেব চিন্তা করবেন।

‘তোমার ডিউটি শেষ কখন?’

‘রাত আটটায়।’

‘আমি থাকব তোমার গেটে?’

‘কেন?’

‘তুমি আমার সঙ্গে যাবে।’

‘ঝিনুক তুমি কি সমাজ বলতে কিছু মানো না? জানাজানি হয়ে গেলে লোকে কী বলবে?’

ঝিনুক হাসতে-হাসতে বলে, ‘জানাজানি হলে বলব আমরা বিয়ে করেছি। তখন আর কেউ কিছু বলবে না।’

‘আমরা তো বিয়ে করিনি।’

‘করিনি সেটা আমিও জানি। যেমন সমাজ তেমন ব্যবস্থা করতে দোষ কী? আর তাছাড়া আমি কি পাত্রী হিসেবে খুবই খারাপ?’

‘না না সে কথা নয়, ঝিনুক!’

‘তবে?’

অমিত ঝিনুকের কথায় উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বলে, ‘চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ডিউটিতে যাব।’

‘রাতে তুমি একা ফিরবে?’

আজ আর ফিরব না। রাতে মেসে ফিরতে হবে। না হলে রউফ সাহেব চিন্তা করবেন।


চলবে


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url