তৃতীয় পক্ষ [ষষ্ঠ পর্ব]

 


॥ ছয় ॥


মামুনদের বাসা থেকে বের হতে হতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল। গলি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল সজল। এরই মধ্যে রাস্তায় যানবাহন কমে গেছে। বেশ কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করেও কোন লাভ হল না। কেউ সাত মসজিদ রোড যেতে চায় না। সন্ধ্যা সাতটা-আটটার মধ্যে সিএনজিচালিত স্কুটার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তারপর দু’একটি যা পাওয়া যায়, কেউ এত কম দূরত্বে যেতে চাইল না।

সজল রাস্তা পার হল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে কিছু একটা বাহনের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করল। শেষটায় হাল ছেড়ে হেঁটেই বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিল সজল।

পুলিশের একটা টহল গাড়ি এসে সজলের ঠিক সমানে ব্রেক কষলো। হেড লাইটের তীব্র আলোয় অস্বস্তি লাগল সজলের। হাত দিয়ে চোখ ঢাকার চেষ্টা করল। তাছাড়া সজলের অবিন্যস্ত চুল ও রুক্ষ চেহারা দেখে পুলিশ কিছু একটা সন্দেহ করল। একজন পুলিশ ধমকের সুরে বলল, ‘এতো রাতে কোথায় যাচ্ছেন?’

‘বাসায়।’ সজলের নির্লিপ্ত উত্তর।

‘কোথায় ছিলেন এতো রাতে? কী করছিলেন খুন না ডাকাতি?’

‘সাটআপ। মুখ সামলে কথা বলুন।’

সজলের তীব্র প্রতিবাদে পুলিশ দুজন চুপসে গেল। এদের একজন এরই মধ্যে গাড়ির সামনে ছিটে বসে থাকা অফিসারের কাছে দৌড়ে গেল।

গাড়ি থেকে নেমে একজন এএসআই সজলের কাছে এল। সজলের প্রতিবাদী কন্ঠ শুনতে পেরে তিনি বুঝতে পারলেন, ওরা যা ভেবেছে তা হয়ত নয়। তিনি নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’

‘বলেছি তো বাসায়।’

‘হেঁটেই যাবেন?’

‘হাঁটতে হাঁটতেই যাব।’

‘কেন?’

‘কেন আবার, রিকশা নেই। হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কি-ইবা করার আছে?’

‘এত রাত করলেন কেন? কোথায় ছিলেন এত রাত অবধি?

‘বন্ধুর বাসায়।

‘বন্ধু কী করে?’

এত কৈফিয়ত চাচ্ছেন কেন?’

‘সন্দেহ হচ্ছে তাই।’

‘কী সন্দেহ?’

সেটা না হয়া থানায় গেলেই বুঝতে পারবেন।’

‘তার আগে ডিএসপি শিহাব উদ্দিনকে একটা টেলিফোন করে জেনে নিন না, সজল নামের এক যুবককে থানায় নেবেন কিনা?’

অফিসার কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, ‘কেন?’

‘কেন সেটা ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন।’

অফিসার ডিএসপি সাহেবকে ফোন করলেন। তারপর ফোন রেখে দিয়ে হেসে বললেন, ‘সরি। বুঝতে পারিনি। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’

অফিসার সজলের কোন আপত্তি শুনলো না। প্রায় জোর করে সজলকে গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন।

সজলের বাবা শিহাব উদ্দিন চৌধুরী অনেকক্ষণ সজলের অপেক্ষায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন। অফিসারের ফোন পাওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে ব্যালকনি থেকে ড্রইং রুমে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।

সজল অপরাধীর মতো ঘরে ঢুকল। সজলকে দেখে এতক্ষণ জিইয়ে রাখা রাগটা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেল শিহাব চৌধুরীর। বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার। এত রাত করলে কেন?’

‘মামুনদের বাসায় গিয়েছিলাম। বের হতে একটু দেরি হয়ে গেলো।’

‘ও। তুমি কি খুব ঘন ঘন ওদের বাসায় যাও?’

‘কেন বাবা? গেলে কোন ক্ষতি আছে?’

‘ক্ষতি হবে কেন? বন্ধুর বাসায় যেতেই পারো। তবে এত রাত করে বাড়ি ফেরা আমি পছন্দ করি না, তুমি তা জানো।’

‘সরি দেরি হয়ে গেছে বাবা। আর কখনও হবে না।’

‘ওকে’।

‘বাবা, মামুনরা খুব অসচ্ছল। ওর মা শিক্ষকতা করে সংসার চালান। মামুনের জন্য একটি চাকরি যোগার করে দিতে পারবে?’

‘কেন পারব না। ওকে একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।’

‘বলব?’ 

‘এবার যাও, হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। তোমাকে খুবই ক্লান্ত লাগছে। এর কারণটা না হয় পরে শুনব। তোমার ফুফু আম্মার শরীরটাও বোধ হয় ভালো নেই। তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন।’

অপেক্ষা! হঠাৎ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলা সজলের। মামুনের কথাগুলো মনে পড়লো তার। এতদিন সজল জানত কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করে না। অথচ আজ জানল বাবা তার জন্য অস্থির হয়ে আছেন, ফুফু আম্মা অপেক্ষা করছেন! তাহলে সেকি এতদিন ভুল করেছে?

মামুনের কথাগুলো কানে বাজতে লাগল বার বার। ‘তোর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করেছেন, তিনি কেউ নন?’

সজলের আসার খবর পেয়ে ফুফু আম্মা সজলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘এতো রাত করে ফিরতে হয়? আমাদের বুঝি চিন্তা হয় না!’

সজল ফুফু আম্মার মুখের দিকে তাকাল। ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল সে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল সজলের। অন্য কোন ভাই-বোন না থাকায় ফুফু আম্মাই ছিল সজলের একমাত্র সাথী। ফুফু আম্মার সাথে সে লুকোচুরি, ক্যারম, লুডু কত কি খেলেছে!

একটু বড় হলে সজল ফুফু আম্মাকে দাবা খেলা শেখাতে চাইলে ফুফু আম্মা বলেছিলেন, ‘এই খেলাটা আমি পারব না বাবা!’

‘কেন পারবে না?’

‘কী করে পারব! এটা তো রাজা-রাজড়াদের খেলা।’

‘কে বলেছে তোমাকে?’ সজল হেসে উত্তর দিয়েছিল।

‘বলতে হয় বুঝি? মন্ত্রী, ঘোড়া, হাতিÑ এদের নিয়ে কি আমার মতো গরীবের মেয়ের খেলা চলে?’

সজল হো-হো করে হেসে উঠে বলেছিল, ‘তুমি গরীবের মেয়ে হবে কেন? তুমি তো আমার ফুফু আম্মা।’

সেদিন সজলের যুক্তির কাছে হার মেনে দাবা খেলা শিখেছিলেন মমতাজ বেগম। তারপর খেলতে খেলতে খুব ভালোই শিখেছিলেন তিনি।

খেলার মধ্যে প্রায়ই সজল ভুল চাল দিলে ফুফু আম্মা তাকে সাবধান করে দিতেন। একদিন সজল মন্ত্রির চাল দিতে গেলে মমতাজ বেগম বললেন, ‘মন্ত্রী কেন? ওটা ওখানেই থাক। কিস্তি দিয়ে আমার রাজাকে চেক দে তো!’

শিখিয়ে দেয়া চাল দিয়ে ফুফু আম্মাকে প্রায়ই হারিয়ে দিত সজল।

‘তুমি আমাকে চাল শিখিয়ে আমাকে জিতিয়ে দিচ্ছো, আর নিজে হেরে যাচ্ছ!’

ফুফু আম্মা সজলের পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘আমি চাই তুই সারাজীবন জিতে যা। তোর কাছে আমার হারতেই ভালো লাগে বাবা।’

‘তুমি কি তাহলে ইচ্ছে করে হারো?’

মমতাজ বেগম তটস্থ হয়ে বলতেন, ‘আরে না-না, ইচ্ছে করে কেউ কি হারে কখনো? সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজের চালটা ঠিক বুঝি না।’

‘তাহলে আমি তোমাকে শিখিয়ে দেই?’

তুই তো আমাকে খেলা শিখিয়েছিস।’

‘আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম, তোমার দু’একটা চাল আমিও বলে দেই।’

‘তা দিস। তবে আরেকদিন।’

এরপর যতদিন খেলতে বসেছে ততবারই সজল ফুফু আম্মাকে চাল শিখিয়ে দিতে চেয়েছে। ফুফু আম্মা প্রতিদিনই বলে এসেছেন, ‘আজ নয়, আরেকদিন।’ আরেকদিন কোন দিনই ফুরোয়নি ফুফু আম্মার মুখ থেকে।

একদিন সজল মমতাজ বেগমের সঙ্গে খেলতে বসল। তিনি একটা হাতির চাল দিলেন। সজল বলল, ‘হাতির চালটা তুমি দিও না।’

‘কেন?’

হাসি গোপন রেখে মমতাজ বেগম মুখ তুলে তাকালেন সজলের দিকে।

‘এই দ্যাখো তোমার ঘোড়া দিয়ে কি সুন্দর একটা চাল দিয়ে দিচ্ছি।’

‘সজল ওর ফুফুর একটা ঘোড়াকে এমনভাবে চেলে দিলো যে, সজলের একটা হাতি অথবা ঘোড়া খোয়া যায় যায় অবস্থা।

ফুফু আম্মা প্রতিবাদ করলেন, ‘না বাবা, আমার হাতি-ঘোড়া খেয়ে লাভ নেই।’

‘তাহলে কী করবে তুমি?’

‘আমি হাতিই চালব।’

‘তাতে কী লাভ তোমার?’

‘কেন, দুই চাল পরে মন্ত্রী দিয়ে তোমার কিস্তি মাত করব।’

সজল হো-হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘সত্যিই ফুফু আম্মা তুমি খুবই বোকা!’

আরেক দিন সজলের সঙ্গে খেলতে বসে পর পর দুই গেম হেরে গেলেন মমতাজ বেগম। সজল বলল, ‘তোমার সঙ্গে খেলে লাভ নেই।’

‘লোকসান হলো কোথায়?’

‘তুমি শুধু শুধু হেরে যাওÑবোকার মতো হারো। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, তুমি কি ইচ্ছে করে হারো?’

‘আরে না না, ইচ্ছে করে হারব কেন? তোর সঙ্গে বুদ্ধিতে পারি না বলেই তো হারি।’

‘তোমার লজ্জা করে না?’

সজলের কথা শুনে মমতাজ বেগম হেসে লুটিয়ে পড়লেন।

‘এতে হাসির কী হল?’

‘এই যে বললি, আমার লাজ্জা করে কি না?’

‘সত্যিই তো। তুমি এত হারছো, অথচ লজ্জা করছে না তোমার! আমি এত হারলে কেঁদেই ফেলতাম। জানো, তোমাকে এত হারতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।’

‘হয় বুঝি?’

‘হ্যাঁ, হয়।’

মমতাজ বেগম সেদিন সজলকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন। তারপর মুখে-বুকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হারতে দেখলে সত্যি কি তোর কষ্ট হয় সজল?’

‘তাহলে কি মিথ্যে বলছি?’

‘মিথ্যে ঠিক বলিসনি।’

‘তাহলে তুমি হারো কেন?’

‘ছেলের কাছে মায়ের হেরে যাওয়ায় একটা আলাদা আনন্দ আছে। ও তুই বুঝবি না।’

সজল সত্যিই সেদিন এসব কথার অর্থ বোঝেনি। বুঝলেও তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেনি। আজ মামুন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ফুফু আম্মা ওকে কতটা ভালোবাসেন। তার হৃদয়ের কোন জায়গায় তিনি সজলকে বসিয়েছেন।

ফুফু আম্মা সজলকে বললেন, ‘চল খেতে চল। রাত অনেক হয়েছে।’

সজল বলল, ‘তুমি যাও। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।’

মমতাজ বেগম খাবার গরম করতে চলে গেলেন। সজল বাথরুমে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের চেষ্টা করল।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলল সজল।

‘তুমি কেমন আছো সজল?’

‘ভালো, খুব ভাল।’

‘মিথ্যে বলছ তুমি।’

‘না, মোটেই মিথ্যে বলছি না।’

‘তুমি ভালো নেই।’

‘কেন?’

‘তোমার ভিতর এই মুহূর্তে প্রচ- একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।’

‘কী সেই ঝড়?’

‘এতদিন তুমি তোমার ফুফু আম্মার প্রতি অবিচার করেছো।’

‘অবিচার!’

‘তাকে তুমি মায়ের মর্যাদা দাওনি। অথচ উনি তোমাকে ছেলের মর্যাদা দিয়ে বড় করেছেন।’

‘আমার মা তো মারা গেছেন!’

‘যে মা তোমাকে পেটে ধরেছেন তিনি মারা গেছেন। তিনি তোমার জন্মের নিমিত্ত মাত্র। তিনি তোমাকে পেটে না ধরলেও তোমার জন্ম হতো।’

‘আমার মা না হলেও আমার জন্ম হতো!’

‘এতদিন তুমি গাদা গাদা বই মুখস্ত করেছ সজল। এতে তোমার কতগুলো সার্টিফিকেট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া হয়নি।’

‘এমন আর কী বাকী রয়ে গেলো যে, আমি বুঝিনি?’

‘তুমি কখনও ভেবে দেখনি সৃষ্টিকর্তা কী, সৃষ্টি রহস্যই বা কেন? শোনো সজল, মানুষ মানুষকে সৃষ্টি করতে পারে না। ঈশ্বরই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’

‘তাহলে আমার বাবা-মা?’

‘ওনারা তোমার জন্মের নিমিত্ত মাত্র।’

‘আমি এখন কী করবো?’

কী আর করবে। যতোদিন বেঁচে থাক ভালোবাসার মর্যাদা দিতে শেখ। মততাজ বেগম তোমাকে জন্ম দেননি, কিন্তু ভালোবাসা দিয়েছেন। মায়ের মতই ভালোবাসা। ওনাকে তুমি বুঝতে চেষ্টা কর।

হঠাৎ বাথরুমের দরজায় টোকা পড়ল। ধ্যান ভাঙল সজলের। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে বাথরুম থেকে বের হল সজল। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে দেখল টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করে আছেন ফুফু আম্মা।

কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পরে নিরাভরণ একজন মহিলা সজলের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। যৌবনের প্রথম ধাঁপে বিধবা হয়ে আজও বৈধব্যের রূঢ় কঠিন চিহ্নকে আগলে রেখেছেন তিনি। এতোদিনে একবারও খেয়াল করার সুযোগ হয়নি সজলের। খুব কাছের মানুষও বুকের মধ্যে যন্ত্রণা নিয়ে সেবা করে যান, ভালোবেসে যানÑএদের পৃথিবীতে আসা শুধুই কি দেয়ার জন্য, কিছুই কি পাওয়ার নেই এদের?

সজলের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এই মহিলা তার জন্যÑশুধুই তার জন্য নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন। কেন তিনি সবকিছু বিসর্জন দেবেন? কার জন্য? আজ জানতে হবেÑজানতেই হবে তাকে।

সজল ভাতের প্লেটে হাত ডুবিয়ে কীসব এলোমেলো ভাবছিলো। মমতাজ বেগমের বিষয়টা চোখ এড়াল না।

‘কী হয়েছে সজল, খাচ্ছিস না কেন?’

‘তুমি খেয়েছ?’

‘তোকে না খাইয়ে আমি খাই কখনও?’

চোখ তুলে তাকাল সজল। ‘এটাই কি নিয়ম?’

‘নিয়মের কথা কেন। তোদের সবাইকে খাইয়েই তো আমি খাই। এভাবেই তো চলে আসছে।’

‘আজ তোমাকে আমার সঙ্গে খেতে হবে।’

‘আজ এভাবে কথা বলছিস কেন? আমাকে খুলে বল, কী হয়েছে তোর?’

‘তোমাকে ছাড়া আমার আর কে আছেন, যাকে আমার কষ্টের কথা বলা যায়!’

মমতাজ বেগম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সজলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সজলের মায়ের কথা মনে পড়ল। মাকে সজল দেখেনি। ছবি দেখে দেখে মাকে মা বলে জেনেছে। আজ কেন যেন মায়ের ছবির পাশে ফুফু আম্মার চেহারাটা বার বার ভেসে উঠছেÑফুফু আম্মার বিষণœ মলিন মুখ। চোখে শুধু প্রতীক্ষা। পরনে বৈধব্যের রূঢ় চিহ্ন!

ভাবতে ভাবতে সজলের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

মমতাজ বেগম উঠে গিয়ে সজলের পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, ‘কি হয়েছে তোর, এমন করছিস কেন?

সজল ভাতের প্লেট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে তার ফুফু আম্মার চোখে চোখ রাখল। তারপর হু-হু করে কেঁদে উঠে মমতাজ বেগমের বুকে মাথা লুকাল। বলল, ‘তুমিই আমার মা। আমি এতোদিন তোমার প্রতি অবিচার করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’

মমতাজ বেগমও নিজেকে সামলাতে পারলেন না। কেঁদে কেঁদে অস্থির হলেন। বাঁধা ভাঙ্গা জোয়ারের মতো কান্নার ঢেউ বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে প্লাবিত করে দিল এতদিনের এত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা; এত প্রতীক্ষা, এত প্রহর গোণা।

দুই হাত দিয়ে সজলের মুখ তুলে বললেন, ‘এতদিনÑএতটা বছর আমি তোর মুখ থেকে একবার মা ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করে আছি। ডাক বাবা আর একবার মা বলে ডাক। বার বার ডাক।’

সজল ডাকলো মাÑমাগো। সে ডাক ছড়িয়ে পড়লো বিশ্ব চরাচরে, গ্রহ থেকে গ্রহে, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে।


চলবে

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url