তৃতীয় পক্ষ [পঞ্চম পর্ব]

 


॥ পাঁচ ॥


মায়াবী জোছনায় সজল দেখলো ছাদে নানা রকম গাছগাছালির অনেকগুলো টব। আলো-আঁধারীতে বোঝা গেল না কোনটা কোন গাছ। বেশ ভালো লাগল সজলের। ঘুরে ঘুরে সে ছাদটা দেখতে লাগল। এরপর দু’জনে মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

মামুন কিছু জানতে চাওয়ার আগেই সজল স্বাতীর সঙ্গে দুপুরে হওয়া কথাগুলো বলল। মামুন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো কথাগুলো।

‘স্বাতীকে খুবই ডেসপারেট মনে হলাবুঝি?’ মামুন জিজ্ঞাসা করল।

‘খুবই।’

‘সত্যিই কি একটা কিছু করে ফেলতে পারে?’

‘হয়ত।’

‘নাও তো করতে পারে।’

‘এ রকম মনে হওয়ার কারণ?’

‘মেয়েরা ও রকম বলে, কিন্তু করে না। তাছাড়া আত্মহত্যার কোন পূর্বাভাস হয় না, ঠিক ভূমিকম্পের মত।’

সজল বলল, ‘আত্মহত্যার কথা থাক।’

‘তাহলে?’

‘আমরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসি। আমরা একে অন্যকে পেতে চাই চিরদিনের জন্য।’

মামুন আকাশে কৃষপক্ষের অর্ধেক ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের দিকে তাকালো।

‘ওই চাঁদটাকে দ্যাখ। কী আছে ওতে? শুধু পাথর আর পাথর। তবুও চাঁদ আমাদের এত প্রিয় কেন? ওকে পাই না বলেই তো! কবিগুরুর কথা মনে নেই, ‘যা কিছু পাই তা ভুল করে পাই, তা কিছু চাই তা পাই না।’

সজল অস্থির হয়। ক্ষুব্ধ হয়।

‘কী বলতে চাস তুই?’

‘কাছে পেলে প্রেম মরে যায়। বিরহে প্রেম হয় সত্য। জানিস তো?’

‘জানি, মানি না। ভালোবাসা সব সময়ই যুক্তিতর্কের ওপর।’

মামুনের গানের গলা বেশ ভালো। গুন গুন করে রবীন্দ্র সংগীতের দুটি লাইন গাইলোÑ

‘ন্যায় অন্যায় জানি নে জানি নে জানি নে, শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানিÑ ওগো সুন্দরী...।’

গান থামিয়ে হাসতে হাসতে মামুন বলল, ‘একদিন পস্তাতে হবে কিন্তু। দিল্লিকা লাড্ডু!’

সজল রাগ করল। উঠে দাঁড়াল।

মামুন সজলকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘তাহলে সত্যিই তুই স্বাতীকে বিয়ে করবি?’

‘সাতখ- রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ?’

মামুন হেসে বলে, ‘ঠিক আছে।’

‘কী ঠিক আছে?’

‘এখন বাড়ি যা। রাত অনেক হয়েছে। কাল-পরশু একটা অংক মিলিয়ে ফেলব।’

‘অংক!’

সজল অবাক হয়।

মামুন সব সময়ই হেঁয়ালি করে কথা বলে। ওর আঁকা ছবির মতোই অনেকটা ধোঁয়াশা ওর কথাবার্তা।

‘হ্যাঁ অংক। অংক ছাড়া আর কি? জীবনটাই তো যোগ-বিয়োগ আর পূরণ-ভাগের হিসেব-নিকেশ। কি তাই না?’

‘হেঁয়ালি করিস না তো!’

‘নাইবা করলাম। এমন বাড়ি যা। তোর জন্য বাসায় অপেক্ষা করে আছেন।’

‘আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে না।’ সজল কিতুটা রাগান্বিত ও উত্তেজিত হয়ে বলল।

‘কেউ না?’

‘না।’

‘কেউ অপেক্ষা করে কিনা সেটা বোঝার মতো মানসিকতা আছে তোর?’

‘তোর কী হয়েছে রে?’

‘যা সত্যিই তাই তো বলছি।’

বললাম তো, ‘আমার জন্য কেউ কোনদিন অপেক্ষা করে না।’

‘কেন তোর মা।’

‘মা! তুই তো জানিস আমার মা নেই।’

‘জানি।’

‘তাহলে?’

‘পেটে ধরলেই মা হয়। আর কোনভাবে মা হওয়া যায় না? যিনি তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, তিনি তোর মা নন?’

‘এত কথা তুই জানলি কী করে? আমি তো তোকে কখনও কিছুই বলিনি!’

‘তুই না বললেও আমি জানি। কোনদিন তোকে জানতে দেইনি। আরও একটি কথা তোকে বলছি, যদিও গুরুজনদের নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়। কিন্তু তোকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে হবে, তাই বলতে হচ্ছে। যৌবনে তোর বাবার সঙ্গে স্বাতীর মায়ের একটা সম্পর্ক ছিল। স্বাতী কোনদিন কিছু বলেনি তোকে?’

‘না! স্বাতী হয়তো জানে না সে কথা।’ অবাক হয় সজল।

‘না জানারই কথা। মায়ের সম্পর্কের কথা মেয়ে জানবে কীভাবে?’

‘কিন্তু তুই জানলি কীভাবে?’

‘বোকা!’

‘আমি?’

‘নয় তো কে?’

‘কেন?’

‘আমার মা ও স্বাতীর মা খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। জানিস না?’

‘জানি তো!’

‘মা আমাকে এসব কথা বলেছেন। জানিস তো মা অনেকটা সরল। সরল মানুষ কোন কথা বেশি দিন গোপন রাখতে পারে না। যেমন মা পারেননি।’

‘খালাম্মা সব কথা তোকে বলেন বুঝি?’

‘সব মানুষই তার মনের কথা বলার জন্য কাউকে না কাউকে খুঁজে বের করেন। এই যেমন তুই ছুটে এসেছিস আমার কাছে। আমার মাও দীর্ঘদিনের লালিত দুঃখকে একদিন দুর্বল মুহূর্তে আমাকে বলে দিলেন।’

‘বাবার সঙ্গে স্বাতীর মায়ের বিয়ে হলো না কেন?’

‘কী করে হবে? তোর দাদা নিছার চৌধুরী কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি স্বাতীর মাকে। তোর দাদা ভাবলেন, স্বাতীর মাকে বিয়ে দিতে না পারলে তোর বাবাকে কিছুতেই ফেরাতে পারবেন না। তুই তো জানিস, তোর দাদা ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনিই স্বাতীর মাকে জোর করে অন্যত্র বিয়ে দেন।’

‘দাদা ভীষণ অন্যায় করেছেন।’

‘তারা কী অন্যায় করেছেন, সে বিচার আমরা করতে যাব কেন? তাছাড়া উচিতও নয়। এখন থেকে প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তখনকার মানুষের মন-মানসিকতা আর আজকের আমাদের প্রজন্মের ধ্যান-ধারণা এক নয়। তোর দাদার জায়গায় তুই কিংবা আমি হলে হয়ত একই কাজ করতাম।’

‘স্বাতীর মা কি সুখি হতে পেরেছেন?’

‘পেরেছেন কিনা জানি না। স্বাতীর মাকে তোর কথা বলবো আমি।’

না না বলে প্রবল আপত্তি করল সজল। মামুন অভয় দিয়ে বলল, ভাবিস না, সব ব্যবস্থা করতে অসুবিধা হবে না এতটুকু। একদিন মাকে নিয়ে স্বাতীদের বাসায় যাবো।

সে রাতে ছাদে বসে ওরা দু’জন গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলল। যাবার সময় সজল বলল, ‘তুই ঠিকই বলেছিস, জন্ম না দিয়েও মা হওয়া যায়। যেমন হয়েছেন ফুফু আম্মা।’


চলবে


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url