তৃতীয় পক্ষ । পর্ব ৬


॥ সাত ॥

বাবাকে রাজাকাররা থানায় নিয়ে গেছে শুনে শিহাব অস্থির হয়ে পড়ে। মন খারাপ নিয়ে সে মায়ের কাছে জানতে চায় রাজাকাররা বাবার কোন ক্ষতি করবে কি না। মা ও কয়েকজন প্রতিবেশী শিহাবকে সান্ত¦না দেয়। কিন্তু শিহাবের কোন সান্ত¦নায়ই মন ভরে না। মন খারাপ নিয়ে বাড়ির সামনের পুকুর ঘাটে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে সে।

পুকুরে বেশ কিছু পদ্ম ফুল ফুটে আছে। কিছু ভোমরা ওড়াউড়ি করছে। দু’একটি মৌমাছিও দেখল সে। পদ্ম পাতার ওপর ছোট একটি সোনালি রংয়ের ব্যাঙ হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল। একটা সাপ ব্যাঙটিকে ধরার জন্য এগিয়ে এল। ব্যাঙটিও এ পাতা থেকে ও পাতায় লাফিয়ে যাচ্ছে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। শেষটায় পরাজিত হল সাপটি। এঁকেবেঁকে সাঁতার কেটে অন্যত্র চলে গেল। সাপটির পরাজয় দেখে শিহাবের মন ভালো হয়ে গেল।

বার বার শিহাব পথের দিকে তাকাচ্ছিল। অনেকে বাবাকে নিয়ে কীসব আজেবাজে কথা বলছে। কথাগুলো শুনতে ভালো লাগেনি শিহাবের। প্রচ- অস্থিরতা নিয়ে সে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

নিছার চৌধুরী বাসায় ফিরে এলে সবার মধ্যে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস করল না। শিহাব যে ঘাটে বসে আছে, তিনি তা লক্ষ্য করেননি। শিহাবও বাবাকে দেখতে পায়নি।

নিছার চৌধুরীর স্ত্রী মরিয়ম বেগম স্বামীকে দেখে দৌড়ে তার কাছে এলেন।

‘কী করেছেন আপনি? আপনাকে ওরা থানায় ডাকবে কেন?

‘তোমার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে কি না, জানতে চেয়েছিল।’

‘কী বললেন আপনি?’

‘যা সত্যি, তাইতো বলেছি।’

‘কী সত্যি বলেছেন আপনি!’

‘মুক্তিযুদ্ধে গেছে, সেটাই বলেছি।’

মরিয়ম বেগম জোরালোভাবে প্রতিবাদ করলেন।

‘না, ও মুক্তিযুদ্ধে যায়নি।’

নিছার চৌধুরী অবাক হলেন। বললেন, ‘তাহলে কোথায় গেছে?’

‘বেড়াতে গেছে, মামার বাড়ি।’

মরিয়ম বেগমের কথা শুনে নিছার চৌধুরী হেসে উঠলেন।

‘হাসছেন কেন?’

‘তোমার কথা শুনে।’

‘আমি এমন কী বললাম, যে হাসতে হবে?’

‘দেখ মরিয়ম, তুমি বলছ তোমার ছেলে বেড়াতে গেছে। কোথায় বেড়াতে গেছে, যেখানের কথা বলব সেখানে ওরা খোঁজ করবে। আমি মিথ্যুক বনে যাব। ভাববে আমি ভয় পেয়েছি। এটা কি ঠিক হতো? তাছাড়া জয়নাল বেপারীকে তো জানো, ও আগেই বলে এসেছে সব কথা।’

এবার মরিয়ম বেগম চুপ থাকলেন।

‘শিহাব স্কুল থেকে ফেরেনি?’ নিছার চৌধুরী জানতে চাইলেন।

‘ফিরেছে। আপনাকে থানায় ডেকেছে শুনে খুব মন খারাপ করেছে।’

‘ও এখন কোথায়?’

‘ঠিক বলতে পারব না।’

নিছার চৌধুরী তার এই ছেলেটিকে কেন যেন একটু বেশিই ভালোবাসেন। তার বড় ছেলে তাকে এড়িয়ে চলে, ভয় পায়। শিহাব তার উল্টো। বাবাকে শিহাব একটুও ভয় পায় না। এক মুহূর্তের জন্যেও সে তার বাবাকে চোখের আড়াল করতে চায় না।

নিছার চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলেন শিহাবকে। কয়েকবার গলা ছেড়ে ডাকলেন। কোন সাড়া না পেয়ে উৎকণ্ঠিত হলেন তিনি। জবেদ আলীকে কাছে পেয়ে শিহাবের কথা জিজ্ঞেস করতে দীঘির দিকে ইশারা করল ছেলেটি।

দীঘির পাড়ে এসে নিছার চৌধুরী দেখতে পেলেন শিহাব পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে। আস্তে আস্তে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

‘শিহাব।’

‘বাবা তুমি এসেছ?’

শিহাব ঘাট থেকে উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে।

‘কী হয়েছে তোর?’

‘ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল?’

‘ধরে নেবে কেন? খবর দিয়েছিল। তাই তো গিয়েছিলাম।’

‘ওরা যদি তোমাকে মেরে ফেলত!’

‘মারবে কেন? আমি তো কোন অন্যায় করিনি।’

‘তাহলে সবাই যে কীসব বলাবলি করছে?’

‘সব কথায় কান দিতে নেই।’

‘তোমাকে আর থানায় যেতে দেব না।’

‘ঠিক আছে, যাব না।’

শিহাব কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘বাবা আমিও মুক্তিযুদ্ধে যাব।’

‘তোর তো যুদ্ধে যাবার বয়স হয়নি। তাছাড়া তুইও যদি তোর দাদার মত আমাদের ছেড়ে যুদ্ধে যাসÑ তখন আমরা কী নিয়ে থাকব?’

‘তাহলে কী হবে? আমার যে যুদ্ধ করতে ইচ্ছে করছে। রাজাকারদের গুলি করে মারতে ইচ্ছে করছে।’

নিছার চৌধুরী ফিসফিস করে বললেন, ‘চুপ কর বাপ। এ কথা আর কাউকে বলতে যাসনে। চারদিকে শত্রু, কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।’

নিছার চৌধুরী একটু ভেবে আবার বলতে লাগলেনÑ ‘শোন, কথাটা খুব গোপন রাখবি কিন্তু!’

‘কী বাবা?’

‘আমরা এখানে বসেই মুক্তিযুদ্ধ করব। রাজাকারদের গুলি করে মারব। তুই আমাকে সাহায্য করবি। কী পারবি না?’

‘পারব বাবা।’

‘তাহলে এখন যা, গোসল করে খাওয়া-দাওয়া কর। 

‘তুমি খাবে না?’

‘আমি একটু পরে খাব। তুই এক কাজ কর।’

‘কী বাবা?’

‘তোর পিসিমাকে ডেকে নিয়ে আয়। কারও কাছে বসে বলিস না। একা একা বলবি।’

শিহাব মাথা নেড়ে পাশের বাসায় চলে গেল। নিছার চৌধুরী ঘরে ফিরে এলেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ আর অবশিষ্ট নেই, সবাই যার যার ঘরে চলে গেছে।

একটু পরে পাশের বাড়িতে থেকে প্রণবের মা এলেন। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক।

‘দাদা ডেকেছেন?’

‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে দিদি।’

‘কী কথা?’

‘এখানে আপনার থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়।’

আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু কী করব দাদা, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘আপনাকে পালাতে হবে।’

‘কোথায়?’

‘ভারতে।’

‘কিন্তু কীভাবে?’

‘আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।’

আবেগে উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছিলেন ভদ্রমহিলা।

‘দাদা আপনি বোধ হয় পূর্বজন্মে সত্যি আমার দাদা ছিলেন!’

পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন মহিলা।

প্রণব কোথায়?

‘দুদিন পর্যন্ত কোন খোঁজ নেই।’

‘কিছু বলে যায়নি?’

‘না!’

‘আমার কাছে খবর আছে, ও এখন সুন্দরবনে।’

ভদ্রমহিলা দু’হাত জোড় করে অদৃশ্য ভগবানের উদ্দেশে মিনতি জানালেনÑ ‘ঠাকুর, ওকে তুমি দেখ ঠাকুর।’

‘আজ রাতেই আপনি ভারতে চলে যাবেন।’

‘আজই?’

‘পারলে এখনই পাঠাতাম।’

‘আমার ভীষণ ভয় করছে দাদা।’

‘আপনার ভগবান আর আমার আল্লাহ আপনার সঙ্গে আছেন, ভয় পাবেন না।’

‘সোনা-রূপা, পিতল-কাঁসা এগুলো কী করব?’

‘যা কিছু আছে আপনার বৌদির কাছে রেখে যান। দেশ স্বাধীন হোক, সব কিছু ফেরত পাবেন।’

‘তাই হবে দাদা।’

‘গোছগাছ যা কিছু করার এই বেলা করুন। সন্ধ্যায় আপনি নৌকায় উঠবেন। লোক ঠিক করা আছে। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে গোপন পথে ওরা আপনাকে ভারতে পৌঁছে দেবে।’

‘ঠিক আছে দাদা।’

নমস্কার জানিয়ে প্রণবের মা চলে গেলেন।


চলবে


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url