তৃতীয় পক্ষ । পর্ব ৮
॥ আট ॥
প্রণবের মা নিছার চৌধুরীর কথা মত কাজ করলেন। রাতে ঘরে তালা লাগিয়ে এক কাপড়ে নৌকায় গিয়ে বসলেন তিনি।
রাত দশটার দিকে নিছার চৌধুরী হ্যারিকেনের আলোয় বসে যখন এলোমেলো চিন্তা করছিলেন, ঠিক সে মুহূর্তে অনেকগুলো বুটের শব্দ পেলেন তিনি। জানালা ফাঁক করে তাকিয়ে দেখলেন পুলিশ আর রাজাকার তার বাসার চারদিক ঘিরে ফেলেছে।
হঠাৎ আবার কী হল? তাহলে ওসি সাহেব কি চালাকি করেছেন? এই প্রথম নিছার চৌধুরীর বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। বেশি ভাবার সময় পেলেন না তিনি। দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলো রাজাকাররা।
‘কে?’ নিছার চৌধুরী যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন।
ওসি সাহেবের গলা শোনা গেল, ‘দরজা খুলুন চৌধুরী সাহেব।’
দরজা খুলে দিলেন নিছার চৌধুরী।
ওসি সাহেবকে দেখতে পেলেন নিছার চৌধুরী। ওসি সাহেবের সঙ্গে সেকেন্ড অফিসার ও আরও তিনচারজন পুলিশ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে আরও দশ থেকে বারোজন রাজাকার। নিছার চৌধুরী দেখলেন পুরো বাড়িটা ঘিরে রেখেছে ওরা।
ওসি সাহেব একটু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘দুঃখিত মিঃ চৌধুরী আপনার বাড়িটা সার্চ করতে হবে।’
‘বাড়ি সার্চ করবেন, কিন্তু কেন?’
‘আমরা খবর পেয়েছি, আপনার বাড়িতে অস্ত্র আছে।’
মনে মনে ওসি সাহেবকে একটা বিশ্রী গালি দিলেন চৌধুরী সাহেব।
‘অস্ত্র! অস্ত্র আসবে কোথা থেকে? বন্দুক সে তো থানায় জমা দিয়েছি।’
‘নেই?’
‘না।’
‘ঠিক আছে, না থাকলে তো আপনারও মঙ্গল। এখন আমাদের দায়িত্ব পালন করতে দিন। আমাদের সহযোগিতা করুন।’
নিছার চৌধুরী ভাবলেন, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বেঈমানদের বিশ্বাস করেছেন ভেবে নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে হল। বললেন, ‘ঠিক আছে দেখুন কোথায় অস্ত্র আছে?’ নিছার চৌধুরী দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ‘বিশ্বাসঘাতক’।’
নিছার চৌধুরীর ইচ্ছে ছিল না গালিটা ওসি সাহেব শুনতে পান। কথাটা একটু জোর ছিল সম্ভবত। ওসি সাহেব শুনে হেসে বললেন, ‘গালি দিলেন?’
নিছার চৌধুরী কোন উত্তর দিলেন না।
‘দিন গালি দিন, যত ইচ্ছে দিন। গালি দিলেই তো আর বাংলাদেশটা স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে না!’
নিছার চৌধুরী মনে মনে বললেন, শুয়োরের বাচ্চা, বেঈমান! কীভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হয়, তা দেখার জন্যই তোদের জন্ম। দেখবি, শিগগিরই দেখবি।’
ওসি সাহেব ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ও রাজাকারদের উদ্দেশে বললেন, ‘খেয়াল রেখ।’
ওসি সাহেবের নির্দেশ পেয়ে অনেকগুলো টর্চ লাইটের আলো জ্বলে উঠল। পুরো বাড়িটা আলোকিত করে ফেলল ওরা ।
হঠাৎ এত অপরিচিত লোককে দেখে শিহাবের কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। তারপর একটা গুলির শব্দ। কুকুরটা একটা গোঙানি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো।
রাজাকাররা প্রিয় কুকুরটাকে গুলি করে মেরেছে দেখে শিহাব দৌঁড়ে বাইরে চলে গেল। কেউ আটকাতে পারল না ওকে। শিহাব ওর প্রিয় কুকুরের নিষ্প্রাণ দেহটাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল। তারপর ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন জ্বলা চোখে রাজাকারকে প্রশ্ন করল, ‘কেন মারলে ওকে, কী অন্যায় করেছিল ও?’
রাজাকাররা কেউ শিহাবের কথার কোন উত্তর দিতে পারল না।
ওসি সাহেব তটস্থ হয়ে বাইরে গেলেন। বললেন, ‘কী হয়েছে? গুলি করলে কেন?’
রাজাকার কমান্ডার সুফি পান চিবোতে চিবোতে বিশ্রী হাসি দিয়ে বলল, স্যার কুকুরটাকে শেষ করে দিলাম। ও শ্যালা মুক্তিবাহিনীর চ্যালা।’
‘ইডিয়ট!’ ওসি সাহেব বাইরে গিয়ে শিহাবকে কাছে টেনে নিয়ে দুঃখ করে বললেন, ‘ওরা তোমার কুকুরটাকে মেরে অন্যায় করেছে। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। যে কুকুরকে গুলি করেছে কথা দিচ্ছি তার বিচার করব আমি, কঠিন বিচার করব।
রাজাকারদের উদ্দেশ করে ওসি সাহেব বললেন, ‘যান, ডিউটি করুন। এরপর কোন গুলি করার আগে আমার অনুমতি নেবেন।’
চৌধুরী সাহেব তার দৃষ্টিতে ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন দমিয়ে রাখতে পারলেন না। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘এর খেসারত তোমাকে দিতে হবে সুফি।’
নিছার চৌধুরীর একথা শুনে বিস্মিত ওসি সাহেব বললেন, ‘আমি আপনার সাহসের কথা শুনেছি। আজ নিজে প্রমাণ পেলাম।’ তারপর বললেন, ‘অবশ্যই শোধ নেবেন। যদি সুযোগ মত পান।’
নিছার চৌধুরী ওসি সাহেবের কথায় আরও বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘বাড়ি সার্চ করতে এসেছেন, তাই করুন। আপনাদের এই কুৎসিত চেহারা আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না।’
এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে ওসি সাহেব সেকেন্ড অফিসার ও তিনজন পুলিশ নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। ওদের সঙ্গে চৌধুরী সাহেবও গেলেন। ওসি সাহেব সেকেন্ড অফিসার ও তিনজন পুলিশকে দুটো কামরা দেখিয়ে বললেন, ‘আমি নিজে চৌধুরী সাহেবের রুমটা দেখছি, তোমরা বাকি রুমগুলো দেখবে। সাবধান জিনিসপত্র এলোমেলো কর না যেন!’
ওসি সাহেব নিছার চৌধুরীর বেড রুমে ঢুকে গেলেন। তারপর একটা রিভলবার ও কিছু গুলি চৌধুরী সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সাবধানে থাকবেন।’ কাল সন্ধ্যায় আমরা চলে যাচ্ছি। মাঝির হাতে আপনার চিঠিটা দেবেন। আর আপনার বাড়ি সার্চ করাটা আমার একটা নাটক। এভাবে না করলে আমি চলে গেলে ওরা আপনার বাড়ি সার্চ করত। জয়নাল বেপারী বার বার আপনার বাড়ি সার্চ করার কথা বলছিল।’
নিছার চৌধুরী ঘটনার আকস্মিকতায় লজ্জিত হলেন।
‘আমি দুঃখিত ওসি সাহেব।’
এখন দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। একটা কথা মনে রাখবেন, আপনার এক নম্বর শত্রু দুজনÑ জয়নাল বেপারী ও কমান্ডার সুফি। এই রিভলবারে প্রথম দুটি গুলি ওদের জন্য খরচ করবেন। মনে রাখবেন, তারপর আপনি আশিভাগ নিরাপদ।’
হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন নিছার চৌধুরী। আবেগে তার দুচোখ প্লাবিত হতে যাচ্ছিল। রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি।
ওসি সাহেব ফিসফিস করে বললেন, কাল রাতে আমরা যাবার পর বেশ কয়েকটা গুলির শব্দ শুনতে পাবেন। ঘাবড়াবেন না। আমি সঙ্গে করে একজন রাজাকারকে নিয়ে যাব। ওর লাশটা হয়ত দেখতে পাবেন খালে ভাসছে। আর মাঝির নৌকাটা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়ে যাব, ও থানায় এসে রিপোর্ট দেবে আমাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গোলাগুলি হয়েছে। একজন রাজাকার মারা গেছে আর আমাদের ওরা ধরে নিয়ে গেছে।’
এরপর ওসি সাহেব মানিব্যাগ থেকে দু’শ টাকা বের করে নিছার চৌধুরীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘মাঝির নৌকার ক্ষতিপূরণ।’
নিছার চৌধুরী বাধা দিয়ে বললেন, ‘টাকা রেখে দিন। কাজে লাগবে।’
ওসি সাহেব কথা বাড়ালেন না। হাতটা বাড়িয়ে দিলেন নিছার চৌধুরীর দিকে। হ্যান্ডশেক করে নিছার চৌধুরী বললেন, ‘মে আল্লাহ হেলপ ইউ মাই সান। জয় বাংলা।’
ওসি সাহেব নিছার চৌধুরীকে নিয়ে পাসের রুমে গেলেন। নিছার চৌধুরী দেখলেন সেকেন্ড অফিসার ও তিনজন ফোর্স চুপচাপ বসে আছে। কোন একটি জিনিসেও তারা হাত দেয়নি।
‘আপনাদের হলো?’ ওসি সাহেব বললেন।
‘জি স্যার।’ সেকেন্ড অফিসার একটু হেসে উত্তর দিলেন।
হাসি চাপিয়ে রাখতে পারলেন না নিছার চৌধুরীও।
ওসি সাহেব এবং সেকেন্ডে অফিসার নিছার চৌধুরীর মুখের দিকে তাকালেন।
নিছার চৌধুরী আবারও আবেগাপ্লুত হলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য আজ ওরা বুকের রক্তা দিতেও প্রস্তুত। গর্ব, আনন্দ আর বিচ্ছেদের সুর একাকার হয়ে গেলো যেন!
ওসি সাহেব ফিরে যেতে লাগলেন। একবার ঘাড় ফিরিয়ে নিছার চৌধুরীকে দেখে নিয়ে বললেন, ‘ভালো থাকবেন আশা করি।’
অন্ধকারে মিশে গেল ওরা সবাই। আস্তে আস্তে বুটের ভারি শব্দ বাতাসে মিলিয়ে গেল। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা আবার ডেকে উঠল ঝিঁÑঝিঁÑঝিঁ-ঝিঁ।
চলবে