অপারেশন রেসকিউ । পর্ব- ৩
।। তিন ।।
মফস্বল শহরের একপ্রান্তে অবিনাশের দোকান। বুধবারের হাটের দিন ছাড়া ওর দোকানে খুব একটা ভিড় থাকে না। এ জন্যে বুধবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে সকাল ও সন্ধ্যায় বন্ধুদের আড্ডা জমে ওর দোকানে। অবিনাশের দোকানের বড় আকর্ষণ মন্টু মিয়ার চা। সন্ধ্যা হলেই আমরা প্রায় সব বন্ধু অবিনাশের দোকানে গিয়ে আড্ডা দেই আর পাশেই মন্টু মিয়ার দোকান থেকে চা আনিয়ে খাই। অবিনাশ বন্ধুদের খাওয়াতে পেরে খুব খুশি হয়।
বন্দরে পুলপাড়ে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই সেখানে। এরপর হাঁটতে-হাঁটতে অবিনাশের দোকানের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। কিছুটা দূর থেকে দেখলাম অবিনাশের দোকান বন্ধ।
আকাশে মেঘ থাকায় সন্ধ্যার আগেই চারদিক বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাৎ মাইকের শব্দ শুনতে পেলাম। মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত বন্দরে কারফিউ থাকবে। কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয়।
হঠাৎ দেখলাম নূরু হাঁপাতে-হাঁপাতে এগিয়ে আসছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, অমন করছিস কেন?
Ñশুনিসনি বন্দরে কারফিউ জারি করা হয়েছে?
Ñএকটু আগে শুনেছি।
Ñএখানে আর এক মুহূর্তও নয়। চল, আমরা অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলি।
নূরু আমাকে টেনে অন্ধকারের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বললো, এক্ষুণি পালাতে হবে আমাদের। তাড়াতাড়ি চল। ও হাত ধরে টানতে লাগলো আমাকে।
‘তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?’ নূরুকে বললাম।
Ñকেন ভয় পাচ্ছি বুঝতে পারছিস না? রাজাকাররা কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। নরেন ও সাদিককেও ধরে নিয়ে গেছে ওরা। মোস্তাকদের বাড়ি সার্চ করেছে। ওকে পায়নি। মোস্তাক আগেভাগে টের পেয়ে সটকে পড়েছে। এই দ্যাখ মোস্তাক চিঠিতে কী লিখেছে?
নূরু কাঁপা-কাঁপা হাতে পকেট থেকে একটি চিঠি বের করে আমার হাতে দিলো। অন্ধকারে চিঠি পড়া সম্ভব নয়। বললাম, পড়া যাচ্ছে না, তুই বল কী লিখেছে মোস্তাক?
মোস্তাক লিখেছে আমাদের সবাইকে সাবধান থাকতে। যে কোন সময় রাজাকাররা আমাদেরকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। থানায় ওর এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার ওকে আগেভাগে খবরটা দিলে ও সরে যেতে পেরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মোস্তাক বন্ধুদের মধ্যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সাহসী। সম্প্রতি ও ঢাকা থেকে এসেছে। কয়েক দিন আগে মোস্তাক মুক্তিবাহিনী গঠনের কথা বলেছিলো। আমরা সবাই একমত হয়েছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে—আমরা কেউ তা বুঝতে পারিনি।
সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ শুরু। ছটা বাজতে আর মাত্র মিনিট পনেরো বাকি আছে। এ অবস্থায় কী করা যায়, বুঝতে পারলাম না। নূরু আমার হাত ধরে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো। বললাম, কোথায় যাচ্ছিস?
মোস্তাকের বাসায়—সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো নূরু।
বললাম, কিন্তু ওর বাসা তো অনেকটা দূরে। মাত্র পনের মিনিট বাকি ছটা বাজতে! এখনই তো কারফিউ শুরু হয়ে গেলো বলে!
Ñনূরু বললো, যে করেই হোক মোস্তাকের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। এ অবস্থায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না।
নূরু আমার সঙ্গে কথা বলছে আর আমার হাত ধরে দ্রুত হাঁটছে। অন্ধকার পথ। বৃষ্টির পানিতে রাস্তায় কোথাও-কোথাও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম আমরা। হঠাৎ দেখলাম কয়েকজন রাজাকার এদিকেই আসছে।
ওদের আসতে দেখে দ্রুত একটি ঘরের আড়ালে লুকালাম আমরা। ভাগ্যিস রাজাকাররা আমাদের দেখতে পায়নি!
রাজাকাররা চলে গেলে নূরু বললো, অবস্থা খুব ভালো মনে হচ্ছে না। আমাদের আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিত ছিলো।
কিন্তু কী করতে পারতাম আমরা? আমি বললাম।
বোকার মত কথা বলিস না তো! নূরু ধমক দিলো আমাকে। আবারও বললো, সতর্ক হলে নরেনকে ধরতে পারতো না ওরা।
Ñকী অপরাধ নরেন ও সাদিকের? কেন ধরলো ওরা?
Ñতুই কি বোকা! কেন বুঝিস না, ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। দেখছিস না, কীভাবে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করছে, কীভাবে মানুষের বাড়িঘর লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে!
Ñওরা হঠাৎ কারফিউ জারি করলো কেন?
Ñএটাই তো ভয়ের ব্যাপার। কারফিউ দিয়ে নিশ্চয়ই ওরা ঘরে বসে থাকবে না।
ছটার মধ্যে আমরা মোস্তাকের বাসায় পৌঁছতে পারলাম। ওকে ডাক দিতেই সাড়া পাওয়া গেলো। আমাদের দেখে মোস্তাক অবাক হলো না একটুও। বললো—এসে পড়েছিস? যাক ভালোই হলো।
বললাম—রাজাকাররা কার্ফু দিয়েছে, জানিস তো?
জানবো না কেন? মাইকে ঘোষণা শুনেছি। মোস্তাক বললো।
নূরু বললো, তুই আমাদের সাবধান করে নিজেই বাসায় আছিস!
রাত না হলে ওরা কিছু করবে না। এ জন্যই ওরা কারফিউ দিয়েছে। তাছাড়া তোদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
কিন্তু আমরা যে আসবো, এ কথা তুই ভাবলি কী করে? নূরু বললো।
চিঠি পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করাটাকে তোরা গুরুত্ব দিবি, এটা না বোঝার কী আছে? তোরা না এলে গাঢাকা দিতাম। মোস্তাক বললো।
আমি বললাম, কিন্তু রুদ্রকে তো খবর দেয়া হয়নি। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবো কীভাবে?
আমার কথা শুনে নূরু ও মোস্তাক চিন্তিত হয়ে পড়লো।
নূরু বললো, যে করে হোক ওকে বাসা থেকে বের করে আনতেই হবে।
মোস্তাক বলল, কিন্তু কীভাবে?
নূরু বললো, অন্ধকারটা আরও একটু গভীর হলে ওর বাসায় যেতে পারবো। তাছাড়া বৃষ্টি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। রুদ্রকে বিপদের মধ্যে ফেলে রাখতে পারবো না।
নূরুর কথায় সায় দেয় মোস্তাক। আমি বললাম, তোরা থাক, আমি গিয়ে ওকে বের করে নিয়ে আসি।
মোস্তাক বললো, তিনজনেই যাবো। বিপদ যদি হয় সবার হবে। তোকে একা ছাড়তে পারি না।
নূরু বললো, এখানে আর বেশি সময় অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। চল বেরিয়ে পড়ি।
কিন্তু কোথায় যাবো, ঠিক করেছিস কিছু? মোস্তাক বললো।
আমি বললাম, আপাতত আমাদের বাড়িতে চল। ওখানে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে যা করার করবো।
নূরু সায় দিয় বললো, তুই ঠিক বলেছিস। কারফিউ তো শুধু বন্দরে। তোদের বাড়িটা বন্দরের বাইরে। চল ওখানেই আগে যাই। তবে তার আগে রুদ্রর বাসা থেকে ওকে নিয়ে যেতে হবে।
হঠাৎ ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো। তিনটি ছাতা নিয়ে আমরা তিনজনে রুদ্রর বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। সরাসরি গেলে রাজাকারদের দৃষ্টি এড়ানো কঠিন। তাই একটু ঘুরে ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে রুদ্রর বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা তিনজন।
রুদ্র বাসায়ই ছিলো। আমাদের দেখে ও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বললো, তোরা এসেছিস? কী করবো ভাবছিলাম। রাজাকাররা কারফিউ দিয়েছে। কোথায় যাবো, কীভাবে তোদের সঙ্গে দেখা হবে—ভাবতে ভাবতে সময় নষ্ট হয়েছে। এখন কী করবি, কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলি?
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলো রুদ্র। ওকে খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিলো। মোস্তাক বললো, আর দেরি নয়, চল বেরিয়ে পড়ি।