অপারেশন রেসকিউ । পর্ব-৪
।। চার ।।
রুদ্রকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো। বৃষ্টি তখনও থামেনি। বৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে বেশ জোরে বাতাস বইছিলো। এতে আমাদের সুবিধাই হলো। নিরাপদে থানা সদর থেকে গ্রামের রাস্তায় উঠে আসতে পারলাম আমরা।
বৃষ্টির পানিতে ঠিকমতো রাস্তা দেখা যাচ্ছিলো না। পাশের ধানক্ষেত থেকে ব্যাঙের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। কোথাও-কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছিলো। হাঁটতে-হাঁটতে নূরু বললো, নরেন ও সাদিককে কি রাজাকাররা ছেড়ে দেবে?
কেউ নূরুর কথার কোন উত্তর দিলো না। ওর কথায় যেন কেউ শুনতেই পায়নি। অথবা উত্তর দেয়া ভুলে গেছে সবাই।
আমরা হেঁটে চলেছি নিঃশব্দে। কানের কাছে কার যেন দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম। কেঁপে উঠলো বুক। আতঙ্কিত হলাম—তাহলে কি নরেন ও সাদিককে হারাতে বসেছি আমরা?
এই নির্মম কথাটি কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস পেলাম না। হঠাৎ মোস্তাক বললো, সত্য যতোই কঠিন হোক না কেন, তাকে মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমরা সবাই মোস্তাকের চোখের দিকে তাকালাম। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলাম না। মোস্তাক আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অবিচল হেঁটে চলেছে আমাদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে।
বন্ধু হলেও মোস্তাককে আমরা মোটামুটি সমীহ করি সবাই। ও আমাদের সবার চেয়ে আলাদা। ও যা বলে ভেবেচিন্তে বলে, যা কিছু করে তার প্রতি ষোলআনা বিশ্বাস রেখেই করে। মনে হলো নরেন ও সাদিকের ব্যাপারে মোস্তাক কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। যে কথা মোস্তাক নিজে থেকে বলবে না, সে কথা শতবার জিজ্ঞেস করেও জানা যাবে না—এ কথা আমরা সবাই জানি। এ জন্য কেউ আর এ ব্যাপারে মোস্তাককে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না।
বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হেঁটে চললাম আমরা। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশের মেঘও কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। বাতাসও পড়ে এসেছে অনেকটা। পশ্চিম আকাশের সন্ধ্যা তারাটা জ্বল-জ্বল করে উঠে আসছে মধ্য আকাশের দিকে। আমরা যেন সবাই অপেক্ষা করছি, কখন এই সন্ধ্যাতারা শুকতারা হবে, কখন অন্ধকার কেটে গিয়ে পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্যের সকাল দেখা দেবে।
হঠাৎ মোস্তাক দৃঢ়কণ্ঠে বললো, একটা কিছু করতে হবে। এভাবে আর কতজনকে হারাবো আমরা? কতো অত্যাচার আর সহ্য করবো নীরবে?
কতজনকে হারাবো মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?—নূরু জানতে চাইলো মোস্তাকের কাছে।
বুঝতে পারছিস না? না বোঝার তো কিছু নেই। রাজাকাররা আমাদের সবাইকে টার্গেট করেছে। আজ ওদের দুজনকে ধরে নিয়ে গেছে। সুযোগ পেলে আমাদেরকেও ধরে নিয়ে যাবে। আর একবার ধরে নিয়ে গেলে ওদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া অতোটা সহজ হবে না।
সেই অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো মোস্তাক। বললো, নরেন ও সাদিককে আর ফিরে পাবো বলে মনে হয় না।
কী বলছিস তুই?—রুদ্র ও নূরু দুজনে একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলো।
মোস্তাক বললো, যা বলছি, ভেবেচিন্তে বলেছি। মনে করে দেখ, অমল বাবু, শ্রীকান্ত পাইক, বাতেন ওদেরকে কি ছেড়ে দিয়েছে ওরা? ওদের লাশ তো নদীতে ভাসতে দেখেছি। দেখেছি ওদের লাশ শিয়াল-কুকুর আর শকুনে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে। রাজাকারদের ভয়ে লাশগুলো তুলে এনে কেউ সৎকার করার সাহস পায়নি! আমরা যেন সবাই মরে বেঁচে আছি!...
রুদ্র প্রতিবাদ করলো, না এ হতে দেয়া যায় না। এর একটা বিহিত করতেই হবে।
নূরু বললো, কিন্তু কীভাবে?
রুদ্র বললো, ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
নূরু বললো, তার জন্য অস্ত্র চাই। অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র না হলে কি চলে?
মোস্তাক খুব ধীর-স্থির-শান্তভাবে বললো, ভাবিস না। সব হবে আমাদের। আমাদেরও অস্ত্র হবে। আমরা আজ চারজন আছি। চারজন থেকে চল্লিশ, তারপর চারশোজন হবো—এভাবে এ দেশের প্রতিটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে উঠবে। ভয় কীসের আমাদের?
আমি বললাম, আমরা তাহলে কি ভারতে যাবো, অস্ত্র আর ট্রেনিংয়ের জন্য?
ট্রেনিংয়ের আগে সাহস দরকার। আর অস্ত্র? হানাদার আর রাজাকারদের অস্ত্র কেড়ে নেবো আমরা। আর ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদেরকে নিশ্চিহ্ন করবো একদিন।
মোস্তাকের কথায় আমাদের রক্ত যেন মাথায় উঠে গেছে। আজ এই মুহূর্ত থেকে আমরা যেন এক-একজন একেকটা গ্রেনেড হয়ে উঠেছি। যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারি আমরা। যেন আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারি অত্যাচারীর মসনদে। যেন প্রলয় ডেকে আনতে পারি আমরা।
রুদ্র হঠাৎ কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি শুরু করলোÑ
‘বলো বীর—
চির উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারই নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির
বলো বীর...’
মোস্তাক রুদ্রকে থামিয়ে সান্ত¦না দিয়ে বললো, আমি বুঝতে পারছি তোদের প্রত্যেকের অন্তরে আগুন জ্বলছে। মাথা গরম করে লাভ নেই। আমাদের ধীরে-সুস্থে ভেবে-চিন্তে এগুতে হবে। তার আগে চল বসে পরিকল্পনা করি।
নূরু বললো, কোথায় যাবো আমরা?
আমি বললাম, কেন আমাদের বাড়িতে। বাড়িটা তো গ্রামের মধ্যে।
মোস্তাক বাধা দিয়ে বললো, না। তোদের বাড়িতে থাকা নিরাপদ হবে না। রাজাকারদের মধ্যে এমন কেউ থাকতেই পারে যে তোদের বাড়িটাও চেনে।
বললাম, তাহলে?
মোস্তাক বললো, তোর পরিচিত কারও বাড়িতে যাওয়া যায় না?
মোস্তাকের কথায় ভাবতে লাগলাম কোথায় যাওয়া যায়। হঠাৎ রাস্তার পাশে পটলের বাড়িটা চোখে পড়লো। বিকেলে পটল দেখিয়েছিল আমাকে। বললাম—আছে।
রুদ্র বলল, কী?
বলললাম, একটা নিরাপদ জায়গার কথা আমার জানা আছে। সেখানে গেলে, যদি ওরা থাকতে দেয় তাহলে কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না। যতোদিন খুশি নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবো আমরা।
মোস্তাক বললো, কোথায়?
আমি তখন পটলের কথা খুলে বললাম। ওদের বাড়িটাও দেখিয়ে দিলাম।
মোস্তাক বললো, কিন্তু পটলের মা রিস্ক নিতে চাইবে কেন?
নূরু বললো, হয়তো চাইবে না। চেষ্টা করে দেখতে তো পারি।
সদর রাস্তা থেকে প্রায় একশো গজ দূরের পটলদের ঘর। আমরা সদর রাস্তা ছেড়ে বাগানের মধ্যে ঘন ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে গিয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল আমাদের।
দূর থেকে পটলদের বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখলাম। আস্তে-আস্তে এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে পটলকে ডাকলাম—পটল, পটল, এই পটল...
‘কেডা?’—ভিতর থেকে একজন মহিলার গলা ভেসে এলো।
বললাম, পটল আছে, পটল?
কিন্তু আপনি কেডা? রাইতের বেলা পটলের কাছে কী কাম?
মহিলা একটি কুপি হাতে দরজা খুলে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ালো। তার পরনে আটপৌরে শাড়ি, মুখে ঘোমটা টানা। বুঝলাম এই মহিলাই পটলের মা হবেন। বললাম, আপনি বুঝি পটলের মা?
হ, আমিই পটলের মা? কিন্তু আপনারা...! মহিলা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো।
কী জানি, হয়তো আমার গলা চিনতে পেরেছে পটল। দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, আপনি!
বললাম, হ্যাঁ পটল আমরা। খুব বিপদে পড়ে তোমাদের এখানে এসেছি।
ওর মা বললো, বিপদ?
বললাম, খুব বিপদ।
এই পটল তুই কি হ্যাগো চেনো? পটলের মা জিজ্ঞেস করলো।
পটল আমাকে দেখিয়ে বললো, এই স্যারের সঙ্গে বিকালে দেখা হইছিলো মা। হের ছাতি বাতাসে উল্টাইয়া ধানক্ষেতের মধ্যে লইয়া গেছিলো। আমি তুইল্যা দিছি।
মহিলা দরজা ছেড়ে দিয়ে বললো, আহেন, ভিতরে আহেন।
পটলদের ঘরটি খুব ছোট। ওর মা একটি মাদুর এনে বিছিয়ে দিলে আমরা চারজন ঠাসাঠাসি করে সেই মাদুরের উপর বসলাম। চারদিকে দেখে মনে হলো পটলরা খুব গরীব। ছোট্ট এই একটিমাত্র ঘরে মা-ছেলে খুব কষ্ট করে থাকে।
পটলের মা বললো, আপনাগো বিপদের কথা কইছিলেন, কী বিপদ হইছে আপনাগো, খুইল্যা কইবেন?
কিছু একটা বলতে গেলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে মোস্তাক বললো, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে আজ বিকেলে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আমরা জানি, রাজাকাররা ওদের মেরে ফেলবে। রাজাকাররা যদি আমাদের ধরতে পারে, তাহলে আমাদেরকেও রেহাই দেবে না—মেরে ফেলবে ওরা।
মোস্তাকের কথা শুনে আমরা তিনজনে ওর দিকে তাকালাম। কী বলছে মোস্তাক, আমরা মুক্তিযোদ্ধা হলাম কখন থেকে!
আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মোস্তাক ইশারা করতেই চুপ হয়ে গেলাম আমরা।
মোস্তাকের মুখে মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনে আমাদেরকে অবাক চোখে দেখতে লাগলো পটল। চোখের পলক দিতেও যেন ভুলে গেছে ও।
বললাম, কী রে পটল! কী দেখছো অমন করে?
স্যার, আপনি যে মুক্তিযোদ্ধা হেইডা তো কন নাই!
বললাম, বললে কী হতো?
পটল বললো, আপনারে আরেকটু ভালো কইর্যা দেখতাম।
ওর কথা শুনে সবাই হো-হো করে হেসে উঠলো।
পটলের মা বললো, হায় আল্লাহ, কী কইতাছেন? রাজাকাররা দুইজনেরে ধইয়া নিয়া গেছে, তাহলে তো আর রক্ষা নাই!
আমি বললাম, আমাদের একটু আশ্রয় দরকার।
কয়েক মুহূর্ত ভাবলো পটলের মা। তারপর বললো, আপনারা হইলেন গিয়া মুক্তি। আপনাগো আশ্রয় দিতেই হইবো। কিন্তু কোথায় আশ্রয় দিমু আপনাগো?
পটল বললো, কেন মা, দাদার ওই তাঁতের ঘরটা তো পইড়া রইছে। ওইহানেই হেরা থাকতে পারবো।
পটলের মায়ের মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, হেইডা তো ভুইল্যাই গেছিলাম। পটল ঠিকই কইছে, আমাগো বড় একটা ঘর আছে। দক্ষিণ দিকের বাগানের শ্যাষ মাথায়। পটলের দাদার তাঁতঘর ছিলো ওইডা। বেশ লম্বা ঘর। আপনারা ওই ঘরে থাকতে পারবেন। তয়...
মোস্তাক জিজ্ঞেস করলো, তবে কী?
ওই ঘরটায় আমরা থাকি না। সবাই বলে ওইটা নাকি ভূতের ঘর! রাইতের বেলা তাঁত চালানোর খট্-খট্ আওয়াজ পাওয়া যায়।
পটলের মায়ের কথা শুনে মোস্তাক হো-হো করে হেসে উঠলো। রুদ্রও ওর সঙ্গে যোগ দিলো। ভূতের কথা শুনে নূরু ও আমার মুখ শুকিয়ে গেলো। দেখলাম নূরু ঢোক গিলছে। নূরুর দেখাদেখি আমিও ঢোকা গিললাম।
বললাম, তাহলে থাক। ভূতের ঘরে থাকতে পারবো না।
মোস্তাক আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো।
পটল ওর দুই চোখ বড়-বড় করে বললো, সত্যি স্যার, ওইটা ভূতের ঘর। আমরা কেউ যাই না ওই ঘরে। গ্রামের কোন লোকও ওইহানে যাইতে সাহস করে না।
পটলকে কাছে টেনে নিয়ে মোস্তাক বললো, ভূত বলে কিছু নেই পটল। সবই মনের ভুল।
পটল বললো, জানেন, ভূতে একদিন বাপজানের গলা চাইপ্যা ধরছিলো। হেয় খুব ভয় পাইছিলো। হেরপর আর ওই ঘরে কোনদিন যায় নাই।
পটলের মা বললো, আপনারা যদি সাহস কইর্যা থাকতে পারেন, আমাগো আপত্তি নাই।
পটল বললো, মা হেগো ঘরটা দেহাইয়া আনি?
ওর মা বললো, তুই তাহলে কুপি লইয়া হেগো লইয়া যা। সাবধানে যাইস, সাপকোপ থাকতে পারে।
একে তো ভূতের ভয়ে সেঁটিয়ে আছি, তার ওপর সাপের কথা শুনে শিউরে উঠলাম। আস্তে-আস্তে ওদেরকে অনুসরণ করতে লাগলাম। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে হলো, এই বুঝি ভূতে গলা টিপে ধরলো।
চলবে