কিছু স্মৃতি কিছু কথা ।। ভূত না কি অন্য কিছু!

 


ভূত না কি অন্য কিছু/নাসির আহমেদ কাবুল

ছেলেবেলার কথা।  আমি ভীষণ ভূতের ভয় পেতাম।  না, তেমন কোনো ভূতের গল্প শুনিনি আমি ছেলেবেলায়। মা আমাকে রূপকথার গল্প শুনাতেন মাঝে মধ্যে। বিশেষ করে ডালিম কুমারের  একটি গল্প রোজই শুনতাম মায়ের মুখে। তিনি কখনো ভূতের গল্প বা কথা বলতেন না। বাবার সঙ্গে আমার সখ্য ছিল খুব, তবে তিনি কখনো কোনো গল্প শুনাতেন না। সে সময় তার ছিল না, তিনি ব্যাংকে চাকরি করতেন।  এলাকায় নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তার অন্যতম সখ ছিল সুন্দরবনে হরিন শিকার ও বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করা। বাবা  বন্দুক দিয়ে গুলি করে নৌকায় করে জীবিত হরিন নিয়ে আসতেন। জীবনে প্রচুর হরিনের মাংস খেয়েছি বাবার শিকার করা। বাবা সুন্দরবন ভ্রমণের ওপর একটি বই লিখেছিলেন। ১৯৬২ সালের বন্যায় সেটি নষ্ট হয়ে যায়।

ভূতের কথা শুনেছি মানুষের কাছে। সব বটগাছেই নাকি ভূত থাকে। আমি বটগাছ থেকে  একশ হাত দূরে থাকতে চাইতাম। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল জমিদার বাড়ি। জমিদাররা  থাকেন না সে বাড়িতে। আমি কখনো জমিদারদের দেখিনি। তবে তাদের ভাঙ্গাচোরা বাড়িটি দেখেছি। জমিদার বাড়িতে ছিল তিনটি পুকুর- এখনও আছে হয়তো, ঠিক খবরটা জানি না। দুটি পুকুর বাড়ির সামনে। তারই পাশে  একটি বটগাছ। বটগাছের নিচে কয়েকটা মূর্তি দেখেছি আমি অনেকদিন। এই গাছটির নিচে নাকি জমিদাররা পুজো করতেন। তারা চলে যাওয়ার পর আর সেখানে কেউ পুজো করেননি, তবে কয়েকটি প্রতিমা  ছিল অনেক বছর। আমি  এই বটগাছটিকে ভীষণ ভয় পেতাম। গাছটির নিচ দিয়ে পায়েচলা পথটিকে আমি সব সময় এড়িয়ে যেতাম। যেতে হলে  কেউ একজন সঙ্গে না থাকলে যেতাম না সে গাছটির নিচ দিয়ে।  কেউ পাশে থাকলেও আমার শরীর কেমন শির শির করে উঠতো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর জমিদাররা এ দেশ ছেড়ে, জমিদারি ছেড়ে ভারতে চলে যান। তারপর থেকে বটগাছটির নিচে কেউ পূজা করে না। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে জমিদারের কয়েকজন এসেছিলেন পুরানো ভিটে মাটি দেখতে। তখন তারা ঘটা করে বটগাছের নিচে প্রতিমা বসিয়ে পূজা করে গেছেন।

আমার প্রচণ্ড ভূতের ভয় থেকে হয়তো মাঝে মধ্যে স্বপ্ন দেখতাম।  আমি ঘুমের মধ্যে দৌড়ে পুকুর পাড়ে চলে  যেতাম, যেখানে একটি গাবগাছ আছে। আমাকে কেউ বাধা দিলে  আমি প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠতাম। তখন আমি হুঁশে থাকতাম না। যতক্ষণ হুশে না আসতাম ততক্ষণ চিৎকার করতে থাকতাম।

একবার বাবা একজন ফকিরকে দিয়ে   আমাকে চিকিৎসা করালেন। সেই ফকির রাতের  বেলা আমাদের ঘরের বারান্দায় বসে জ্বিন হাজির করে কার কী হারানো গেছে, কার কী রোগ সে ব্যাাপারে পরামর্শ দিতো। আমাকে বাবা জ্বিন হাসিল করা ফকিরের কালে বসিয়ে দিলেন। ফকির আমাকে তার কোলে করে বুকের মধ্যে চেপে ধরলে  আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার মনে হয়, যে ফকির আমাকে চেপে ধরেছে, সে মানুষ হতে পারে না। তার বুকের পশমগুলো কাঁটার মতো। আমি সেদিন বিশ্বাস করেছিলাম যে, মানুষ সত্যিই তার ভিতরে জ্বিন হাসিল করতে পারে। তার সেই চিকিৎসায় আমি ভালো হই নাই। তবে তার কিছুদিন পর আমাদের এলাকায় ‘আলতাফ পীর’-এর আবির্ভাব হলো। তার পানিপড়া দিয়ে গোসল করে আমার  সেই চিৎকার করা রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম।





Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url